ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রুমেল খান

লক্ষ্য আরও সুদূরপ্রসারী

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

লক্ষ্য আরও সুদূরপ্রসারী

২৫ আগস্ট। বাংলাদেশী সব ক্রীড়াপ্রেমীর দৃষ্টি নেপালের কাঠমান্ডুতে। সাতদোবাতোর আনফা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাফ অ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল ম্যাচ। এতে স্বাগতিক নেপালের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ম্যাচে বাংলাদেশ দল ২-৪ গোলে হেরে যায় নেপালের কাছে। এই হারে যখন ক্রীড়ামোদীরা মুষড়ে পড়েছিলেন তখন সুদূর কিরগিজস্তান থেকে আসা একটি সুখবরে তাদের মুখে ঠিকই হাসি ফোটে। বিষণœ মন হয়ে ওঠে প্রসন্ন। সেখানকার বিশকেকের সুপারা চুনকারচকে রিকার্ভ ইন্টারন্যাশনাল আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষ এককে স্বর্ণ জেতেন বাংলাদেশের আরচার রুমান সানা। ফাইনালে তিনি রাশিয়ান আরচার আলেক্সি নিকোলায়েভকে হারান ৬-০ সেট পয়েন্টে। রুমান সানার ক্যারিয়ারের এটি চতুর্থ আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ-২ ওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে রিকার্ভ এককে প্রথমবারের মতো স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকায় আইএসএসএফ ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে দলগতভাবে একটি এবং মিশ্র দলগতভাবে একটি স্বর্ণপদক অর্জন করেন। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, আন্তর্জাতিক আরচারিতে বাংলাদেশী হিসেবে সবচেয়ে বেশি (৪টি) একক স্বর্ণপদকধারী আরচার কিন্তু এখন পর্যন্ত রুমানই। শুধু তাই নয়, আরও আছে। ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৬... টানা তিন বছর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জেতার কৃতিত্ব আছে সুদর্শন আরচার রুমানের। রুমানের আগে ও পরে এমন কৃতিত্ব আর কোন আরচারের নেই। পাঠাকের জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০১৫ সালে কিন্তু জাতীয় আরচারির আসর অনুষ্ঠিত হয়নি। হলে হয়তো ওই বছরও সোনা জিততেন সানা! রুমানের আরেকটি কৃতিত্ব হলোÑ ২০১৪ আসরে রুমান ৩৩৫ পয়েন্ট স্কোর করে ভেঙ্গে দেন ইমদাদুল হক মিলনের ২০১০ সালে গড়া ৩৩৩ পয়েন্টের জাতীয় রেকর্ড। রুমানের এই রেকর্ড এখনও অক্ষুণœ। জাতীয় পর্যায়ে সানা একক, দলগত ও মিশ্র দ্বৈতে সোনার পদক জিতেছেন মেটি ৭টি। এগুলোর মধ্যে আছে ২০১৩ বাংলাদেশ গেমসে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদকও। ক্যারিয়ারে নিশ্চয়ই আরও অনেক আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক করায়ত্ত করবেন রুমান। কিন্তু কখনই ভুলতে পারবেন না প্রথম আন্তর্জাতিক সোনাজয়ের সেই দিনটি (ঠিক যেভাবে মানুষ ভুলতে পারে না প্রথম প্রেমের স্মৃতি)। ১৫ মার্চ, ২০১৪। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক। এশিয়ান আরচারি গ্রাঁ পি্রঁ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের কোন আরচার যদি স্বর্ণ পান, তাহলে তিনি হবেন শেখ সজীব অথবা ইমদাদুল হক মিলনÑ এমনটাই ধারণা করেছিলেন বাংলাদেশের আরচারিপ্রেমীরা। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে রুমান সানা রিকার্ভে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন, সৃষ্টি করেন আলোড়ন। রাশিয়ান আরচার সাইবেক দোরঝিভকেক বেয়ারকে ৬-৪ সেটে হারিয়ে এ অর্জন তার। ২০০৮ সালে বিকেএসপিতে ক্যারিয়ার শুরু হয় রুমানের। এরপর ২০১২ সালে ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাব এবং ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ আনসার ও ভিপির হয়ে খেলে যাচ্ছেন ২২ বছর বয়সী এই আরচার। খুলনার ছেলে রুমান। বাগালির কয়রাতে তার গ্রামের বাড়ি। বাবা চাকরিজীবী আব্দুল গফুর সানা এবং গৃহিণী মা বিউটি বেগমের ২ ছেলে, ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রুমান। জন্ম খুলনায়, ৮ জুন, ১৯৯৫ সালে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর ডিগ্রী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুমান বলেন, ‘আরচারিতে মনোযোগ দিতে গিয়ে এবং বিদেশে খেলতে যাবার সময়টাতেই বারবার পরীক্ষা থাকার কারণে আমাকে পড়াশোনায় কয়েক বছরের জন্য গ্যাপ দিতে হয়েছে। এটা আমার জন্য ট্র্যাজেডি!’ পাঠকের নিশ্চয়ই আগ্রহ হচ্ছে ক্রিকেট-জোয়ারে ভেসে না গিয়ে রুমান কেন ও কিভাবে হয়ে উঠলেন এক প্রতিভাবান ধনুর্বিদ। আসলে রুমান ক্রিকেট-ফুটবলই বেশি খেলতেন। ভালই খেলতেন। খুলনার যে স্কুলে পড়তেন নবম শ্রেণীতে (স্কুলের নাম শিশু মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়), সে স্কুলের সহ-সভাপতি হাসান স্যার (তার পুরো নামটি মনে নেই রুমানের)। ২০০৮ সালের কথা। এক সপ্তাহের জন্য বিকেএসপির একটি যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হবে খুলনায়। হাসান স্যার রুমানকে আরচারি খেলা সম্পর্কে ধারণা দেন এবং ট্রায়াল দিতে উৎসাহিত করেন। তার কথা শুনে ট্রায়াল দেন রুমান এবং প্রথমবারেই টিকে যান। কিন্তু ঝামেলা বাদে এরপর। ট্রায়ালের চূড়ান্তে পর্বে যোগ দেবার আগে বিষয়টি জানতে পেরে রুমানের মা-বাবা বেঁকে বসেন। কিছুতেই তারা ছেলেকে যেতে দেবেন না বিকেএসপিতে। পরে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করানো হয় তাদের। রুমান এ পর্যন্ত যত সাফল্য পেয়েছেন তার নেপথ্য রূপকার কে? তিনি আর কেউ নন, জাতীয় আরচার দলের কোচ নিশীথ দাস। আরচারিতে রুমান সবসময়ই নিশীথ দাসকে গুরু মানেন। কিরগিজস্তানে স্বর্ণজয়ের পর অনুভূতি কেমন ছিল? ‘কিরগিজস্তানে মাত্রাতিরিক্ত ঠা-া পড়েছিল। রাতে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়েও শীত দূর করা যায় না, এমন শীত। ফাইনালের দিন সৌভাগ্যক্রমে রোদ ওঠে। খেলার সময়ও পিছিয়ে দেয়া হয়। রোদ পেয়ে শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে একটু একটু করে আত্মবিশ^াস তৈরি হয়। মনে হচ্ছিল স্বর্ণ জিততে পারব। যখন রিকার্ভোতে স্বর্ণ জিতি তখন তো যতটা না আনন্দিত হই তারচেয়ে দ্বিগুণ আনন্দিত হন চপল স্যার। তিনি তো আনন্দের আতিশয্যে আমাকে তার কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে বিকট চিৎকার দেন। আসলে সবসময়ই তিনি আমাকে পুত্র¯েœহে আদর করেন। তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইলে দেশে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলি। তারা আমার সাফল্যের সংবাদ শুনে যারপর নাই আনন্দিত হন।’ জনকণ্ঠকে এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান রুমান। আরচারি নিয়ে রুমানের স্বপ্নটা অনেক বড়, ‘আমি হতে চাই বিশ্বের সেরা ১০ আরচারের একজন। এজন্য যত পরিশ্রম বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই আমার। এজন্য আরচারি ফেডারেশন থেকে যতটা সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা সবই পাচ্ছি।’ রুমানের নেক্সট মিশনÑ আগামী ২৬ নভেম্বর থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য ২০তম এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়া। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘এ আসরে অনেক শক্তিশালী আরচারের সমাগম ঘটবে। এখানে স্বর্ণ জেতা খুবই দুরূহ। তারপরও অন্তত একটি পদক জিততে চাই।’ এই আসর উপলক্ষে গত জানুয়ারি থেকেই টঙ্গীতে আরচারির ক্যাম্পে নিবিড় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন এ পর্যন্ত আরচারি খেলতে বিশ্বের আটটি দেশ (ইরান, ভারত, থাইল্যান্ড, কিরগিজস্তান, চাইনিজ তাইপে, তুরস্ক, দ. কোরিয়া ও ডেনমার্ক) সফর করা রুমান। আরচারি নিয়ে দুঃখময় স্মৃতিও আছে রুমানের। ২০১২ সালের আগস্ট। রুমানের জীবনে ঘটে যায় দুঃখজনক এক ঘটনা। খুলনায় রূপসা সেতুর কাছে বাইক চালাতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি, ‘আমার ডান পা ভেঙ্গে যায়। হাসপাতাল এবং বাসার বিছানা মিলিয়ে আমাকে আটটি মাস পঙ্গু অবস্থায় শুয়ে থাকতে হয়। এ সময়টায় নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মানসিক অনেক চাপ গেছে তখন। সেই সময়টায় পর্যাপ্ত আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ায় আরচারি ফেডারেশন। তাদের এই সাহায্য কোনদিনও ভুলব না।’ আরচারি ছাড়াও ফুটবল-ক্রিকেটের মহাভক্ত রুমান। প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি, কাকা, রোনালদিনহো, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো এবং নেইমার। প্রিয় ক্রিকেটার ভারতের শচীন টেন্ডুলকার, পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি, বাংলাদেশের মাশরাফি মর্তুজা, মুশফিকুর রহীম এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। প্রিয় আরচার বাংলাদেশের শেখ সজীব এবং ইমদাদুল হক মিলন। তীর-ধনুকের খেলা আরচারি। ইংরেজী ‘আরচরি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ধনুর্বিদ্যা বা তীরন্দাজের সৈন্যদল। আদিম যুগের মানুষেরা মাংসাশী প্রাণী শিকার করে ক্ষুধা নিবারণ ও হিংস্র প্রাণীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য উদ্ভাবন করেছিল তীর-ধনুকের মতো অস্ত্রের। পরবর্তীতে অবশ্য এ অস্ত্রটি শিকার ও নিজেকে বাঁচানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরিণত হয় মানুষ হত্যার প্রধান হাতিয়ারে। আধুনিক যুগে গুলি, বন্দুক, বোমা আবিষ্কার হওয়াতে তীর-ধনুকের গুরুত্ব আর নেই। না, আছে। সেটা খেলাধুলাতে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে আরচারি হচ্ছে অন্যতম। ভুটানে তো এটি জাতীয় খেলা হিসেবেই স্বীকৃত। ক্রীড়াবিশ্বে অনেক পুরনো ও জনপ্রিয় ইভেন্ট হলেও খেলা হিসেবে আরচারি বাংলাদেশে প্রচলিত হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। ২০০০ সালে। ক’জন আরচারিপ্রেমী এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয় ২০০১ সালে। ২০০২ সালেই মাঠে গড়ায় খেলাটি। সফল হয় একটি ক্রীড়াস্বপ্ন। এ স্বপ্ন গড়ার অন্যতম কারিগর কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ চপল (সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশন)। এখন দেখার বিষয় আগামীতে আরও কটি স্বর্ণ জিতে চপলকে আবারও উল্লাস করার উপলক্ষ এনে দিতে পারেন কি না ধনুর্বিদ্যার এক প্রতিভাবান যোদ্ধা রুমান সানা। সানার তিন রেকর্ড * আন্তর্জাতিক আরচারিতে বাংলাদেশী আরচার হিসেবে এককে সবচেয়ে বেশি (৪টি) স্বর্ণপদক অর্জন। * প্রথম ও একমাত্র আরচার হিসেবে টানা তিন বছর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক অর্জন। * জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৪) এককে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন (৩৩৫, আগের রেকর্ড ২০১০ আসরে ইমদাদুল হক মিলনের ৩৩৩ পয়েন্ট)।
×