ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব

শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালী হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে কালের পরিক্রমায় এটি এখন আর নির্দিষ্ট একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুর্গাপূজা এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সার্বজনীন উৎসব। শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এ উৎসব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সূচনা হলেও ‘উৎসব’ এর রূপ নিয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে সব সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সেতুবন্ধকে সুদৃঢ় করার এক অনন্য সামাজিক উৎসব। বছরে সাধারণত তিনবার দেবী দুর্গার পূজা হয়। যেমন- শরতে শারদীয় দুর্গা, বসন্তে বাসন্তী দুর্গা এবং হেমন্তে কাত্যায়নী দুর্গা। তবে আদিতে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো বসন্ত কালে। একে বলা হতো বাসন্তী পূজা। পুরাণ মতে, সত্যযুগে রাজা সুরথ নিজ পাপ মোচনের জন্য বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। মহাভারতের ভীষ্মপর্বেও উল্লেখ আছে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে জয়লাভের জন্য শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ শুরুর আগে দেবী দুর্গার স্তব করার উপদেশ দিয়েছিলেন। শরৎ কালে দুর্গা পূজার সূচনা হয় মূলত রামায়ণের কাহিনীকে অবলম্বন করে। ত্রেতা যুগে রাক্ষস রাজা রাবণকে বধ ও সীতাকে উদ্ধারের জন্য শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে (অকালে) দেবীদুর্গার পূজা করেছিলেন। অকালে হয়েছিল বলেই এর আরেক নাম ‘অকাল বোধন’। বাংলাদেশে শরৎ কালের দুর্গাপূজাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। কৃষিভিত্তিক বাঙালী সমাজ শরৎকালকেই দুর্গোৎসবের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। উপমহাদেশে কোথায় প্রথম দুর্গাপূজা হয়, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। অনেকের ধারণা, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা হয় তার সূত্রপাত হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দী বা এরও কিছু আগে। আবার কারও কারও মতেÑ বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’-এ দুর্গোৎসবের কথা বর্ণিত হয়েছে এভাবেÑ ‘মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সর্বঘরে/দুর্গোৎসবকালে বাদ্য বাজাবার তরে’। এতে প্রমাণিত হয় ষোড়শ শতকের আগেই দুর্গোৎসব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিণী’ গ্রন্থেও সিংহবাহিনী দেবীদুর্গার পূজার উল্লেখ রয়েছে। তাই বলা যায়, মিথিলাতেও ষোড়শ শতকের আগেই দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল। কিংবদন্তি আছে, শ্রী হট্টের (বর্তমানে সিলেট) রাজা গণেশ পঞ্চদশ শতকে মূর্তি দিয়ে দুর্গাপূজা করেন। এছাড়া ষোড়শ শতকে রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ তার রাজ পুরোহিত প-িত রমেশ শাস্ত্রীর বিধান অনুযায়ী প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয়ে মাটির মূর্তি দিয়ে জাঁকজমকভাবে দুর্গোৎসব পালন করেন। পরবর্তীতে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাদুরিয়ার রাজা জগৎ নারায়ণ সাড়ে নয় লাখ টাকা ব্যয়ে উদ্যাপন করেন বাসন্তী দুর্গাপূজা। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র্র এবং পরবর্তীতে তার উত্তরসূরীরাও সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা করে চলেন। এভাবেই দুর্গাপূজা এক সময় হিন্দু রাজা-জমিদারদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল নব্য ধনীদের মাঝেও। তবে দেবীর আরাধনার চেয়েও তাদের কাছে মুখ্য ছিল পূজার মধ্য দিয়ে সমাজে প্রভুত্ব বিস্তার ও ঐশ্বর্য প্রদর্শনের বিষয়টি। কিন্তু বিশ শতকে এসে দুর্গোৎসবকে সর্বজনীন রূপ দিয়েছে বাঙালীরা। এ সময়ে ব্যক্তিগত পূজার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে প্রচলন ঘটতে থাকে ‘বারোয়ারি’ বা সার্বজনীন দুর্গোৎসবের। এর পর থেকে দুর্গাপূজা আর বিশেষ কোন শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। হাজার বছরের জাত-পাতের বিভেদ চুরমার করে দিয়েছে এ কালের সার্বজনীন দুর্গোৎসব। তথাকথিত উচু-নিচুদের মধ্যে রচনা করেছে মহা ঐক্যের ভিত। এ পূজায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভালবাসার এক অকৃত্রিম বন্ধনে মিলিত হয়। অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দেয় প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়। প্রতিমায় দেবী দুর্গাকে নারী রূপে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি নারী বা পুরুষ কোনটাই নন। পুরাণ মতে, তিনি এক অভিন্ন সত্তা বা মহাশক্তি। সকল দেব-দেবীর সমন্বিত পরমাশক্তি। তিনি বহুরূপিনী। তিনিই ভগবতী, চন্ডী, উমা, পার্বতী এবং আদ্যশক্তি মহামায়া নামে পরিচিত। জীব ও জগতের কল্যাণের লক্ষ্যে একেক সময় তিনি একেক নামে বা রূপে মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছেন। আসলে তিনি আদি শক্তি, ব্রহ্ম সনাতনী। শক্তি অর্থে ব্রহ্মার মহাশক্তিকে বোঝায়। এ শক্তি অনাদি, অনন্ত। তার বিস্তৃতি সর্বব্যাপী। সকল দুর্গতি বিনাশ করেন বলে তিনি দুর্গতিনাশিনী। দুঃখকে নাশ করেন বলে তিনি দুর্গা। আবার অনেকের মতে, স্বর্গ রাজ্যের শাস্তি বিনাশকারী ‘দুর্গ’ নামক এক মহাপরাক্রমশালী দৈত্যকে বধ করার কারণে তিনি দুর্গা নামে অভিহিত। যা হোক, শত্রুর কাছে তিনি সর্বদাই সংহাররূপিনী, আবার ভক্তের কাছে আনন্দময়ী, স্নেহময়ী জননী ও কল্যাণপ্রদায়িনী। পুরাণ তন্ত্রানুসারে, দেবী দুর্গা তাঁর স্বামীগৃহ কৈলাস থেকে বছরের এই সময়ে সপরিবারে পৃথিবীতে বেড়াতে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন চার সন্তানÑ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক ও গণেশ। লক্ষ্মী ধন-সম্পদের প্রতীক, সরস্বতী বিদ্যা-বিজ্ঞানদায়িনী, গণেশ সর্ব কাজের সিদ্ধিদাতা এবং কার্ত্তিক শৌর্যবীর্যের প্রতীক। এ যেন পৃথিবীর জন্য এক মহা আয়োজন। তাদের সকলের আগমনের উদ্দেশ্য জীব ও জগতের সুখ, শান্তি এবং অসুর-অশুভের বিনাশ। দুর্গার পদতলে পদদলিত থাকে অশুভের প্রতীক অসুর। সিংহের ওপর দাঁড়ানো দেবীর দশ হাতে থাকে দশ অস্ত্রÑ ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষèবাণ, শক্তি, ঢাল, ধনু, পাশ, অংকুশ ও কুঠার। দশ হাতে দশ দিক রক্ষা করেন বলেই তিনি দশভূজা। বাংলাদেশের শারদোৎসবে দিন দিন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। প্রতিমা তৈরি, আলোকসজ্জা, তোরণ নির্মাণসহ সবকিছুতেই বেড়েছে এর জাঁকজমকতা। দেবীর আরাধনাকে শুধু ধর্মীয় আঙ্গিকে এবং পূজা মণ্ডপের মাঝে আবদ্ধ না রেখে আমাদের যুব সমাজ এটিকে পরিণত করেছে সকল ধর্ম-মতের মানুষের সামাজিক উৎসব-এ। পূজাকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনা ও আরতিনৃত্য চলে, তেমনি এর পাশাপাশি চলে নানা সামাজিক কর্মকা-ও। সব মিলিয়ে দুর্গোৎসব এখন সকল বাঙালীর উৎসব। বাঙালী মাত্রই আপ্লুত হয় পূজার আনন্দে। [email protected]
×