ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আন্তর্জাতিক কিশোর সম্মেলনে তানযীল রশীদ

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আন্তর্জাতিক কিশোর সম্মেলনে তানযীল রশীদ

ডিপ্রজন্ম - তানযীল রশীদ সম্পর্কে জানতে চাই- তানযীল-সরকারী হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে পড়ছি এইচএসসি ২য় বর্ষে, বিজ্ঞান বিভাগে। নবম শ্রেণীতে থাকতে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম কিশোর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অগ্রগ্রাহী’। এটির সভাপতি হিসেবে কাজ করছি। অর্গানাইজিং সেক্রেটারি এবং বিতার্কিক হিসেবে পাঠ চুকিয়েছি কলেজিয়েট স্কুল ডিবেটিং সোসাইটি এর। এখন বিতার্কিক হিসেবে রয়েছি ডিবেটিং ক্লাব অব মহসিন কলেজে, ক্যাডেট হিসেবে রয়েছি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর - বাংলাদেশ এনসিসিতে। শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরুর পর বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রয়েছি চ্যানেল আগামীতে। সম্পাদক হিসেবে রয়েছি ক্যানভাস ম্যাগাজিনে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক উদ্যোক্তাদের কমিউনিটি ‘অশোকা’ তে আছি ইয়ুথ ভেঞ্চারার এবং চেইঞ্জমেকার হিসেবে। ডিপ্রজন্ম - আন্তর্জাতিক কিশোর সম্মেলন ২০১৭তে যাবার অনুভূতি - তানযীল – সৃজনশীল কাজগুলো যখন শুরু করি, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি স্বপ্ন পুষে রেখেছিলাম মনে। সেই স্বপ্ন যখন বাস্তবে রূপ নিল খুব দ্রুত সেটা আমাকে খুব বেশি আবেগী করে তুলেছিল, কারণ আমার পথচলাটা ছিল অনেক বেশি অমসৃণ। কনফার্মেশন মেইল পাওয়ার পরই আনন্দাশ্রু এসেছিল। সেটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তানযীল রশীদ ফ্রম বাংলাদেশ ঘোষণার সেই মুহূর্তটি পর্যন্ত যা ছিল বিরাজমান। নিজের স্টোরি শেয়ার করা, আইডিয়া, ভিশন দিয়ে অন্য কিশোরদের অনুপ্রাণিত করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের দুরন্ত কিশোরদের অসাধারণ কাজগুলো আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা আমার জন্য ছিল সত্যিকার অর্থে রোমাঞ্চকর। সেই আনন্দ, রোমাঞ্চ সত্যিকার অর্থে আমি শব্দ কিংবা বাক্য দিয়ে বোঝাতে সমর্থ নয়। অন্যরকম আবেগ আর অনুভূতি। ডিপ্রজন্ম - টিন চেঞ্জমেকারদের সম্মেলনে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছ, সেখানে যাওয়ার জন্য যা যা করতে হয়েছে বল- তানযীল – এপ্লিকেশন ডেডলাইন শেষ হওয়ার অনেক আগেই এই সম্মেলন এবং স্পিকার এপ্লিকেশনের বিষয়টি প্রোগ্রামের কান্ট্রি এম্বেসেডরের ফেইসবুক ওয়ালে দেখছিলাম। কিন্তু এপ্লাই করার সাহস হয়নি। কারণ, চিন্তা করছিলাম ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে আদৌ কমপ্লিট করতে পারব কিনা। এপ্লিকেশন ডেডলাইনের মাত্র ৩ ঘণ্টা আগে ইয়ুথ এলায়েন্সে ইন্টারন্যাশনালের শাহ ইমতিয়াজ হোসাইন ভাইয়্যার সঙ্গে কথা চলাকালীন তিনি আমাকে দ্রুত এপ্লাই করতে বলেন। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে প্রাথমিক এপ্লিকেশন সাবমিট করি। কিন্তু মনে হচ্ছিল না হবে। তবে ইন্টার্ভিউয়ের জন্য সিলেকশন পাই। আমি কমপ্লিট করছিলাম ১ম এবং কম্পিটিটিভ উদ্যোক্তা প্যানেলে, যেখানে মাত্র ৪ জন নেয়া হবে এবং অবশেষে ফাইনালি স্পীকার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে সিলেকশন পাই। কিছু মানুষ আমাকে খুব সহযোগিতা করে সব কাজ ভালভাবে শেষ করার সমর্থন যুগিয়েছে। লাইটস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং টেন মিনিট স্কুলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান সানজিদুল আলম সিবান শান ভাইয়্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের স্টার্টাপ হালট্রিপ ডটকম থেকে আমার এয়ার টিকেট স্পন্সর করাতে আমার যাত্রাপথ ভালভাবে শুরু হয়েছিল। এছাড়াও, ডক্টরস বায়োলজি কোচিংয়ের তৌফিকুল আলম ভাইয়্যা নিজে আমার পারিবারিক কিছু বিষয় ম্যানেজ করে সুন্দরভাবে আমার আন্তর্জাতির মঞ্চে পথচলা সাফল্যমণ্ডিত করেন। আমি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আমার কিছু সিনিয়র ভাইয়্যা, ব্যাচমেট, জুনিয়র যাদের স্নেহ, দোয়া, ভালবাসা আমাকে সৃজনশীল কাজের প্রেরণা যুগিয়েছে। খুব বেশি সাপোর্ট না দিলেও আমি কোন কাজে গেলেই মা আমার জন্য দোয়া করতে বসেন, যেটি আমাকে অনেক বেশি উজ্জ্বলিত করে। ডিপ্রজন্ম - নেপালের কোন স্মরণীয় ঘটনা শেয়ার কর- তানযীল- আন্তর্জাতিক অঙ্গন, সেই সঙ্গে গেস্ট হিসেবে যাওয়ার ফলে অনেক স্মরণীয় ঘটনাই আসলে ঘটেছে। মঞ্চ থেকে নামার পর একজন শ্রীলংকা ডেলিগেট আমাকে বলেন তোমার বয়স কি আসলেই ১৭? তোমার কথা শুনে তোমাকে ৭৭ বছর মনে হয়। নেপালের অনেক কিশোর আমাকে যে সম্মানটুকু দিয়েছেন, সেটা আমাকে বিব্রত করেছিল খুব। কারণ আমি সাধারণ একজন। কিছু করার চেষ্টা করছি, এই যা। উপস্থাপক যখন মঞ্চে আমাকে ডাকছিলেন তখন পরিচয় আর কাজের বর্ণনা দিতেই হাঁপানোর একটা ভান করেন মজা করে। এছাড়া মঞ্চে আমি আমার কাজ নিয়ে স্পিচ শেষ করতেই মোডারেটর বলেন ওকে প্রশ্ন করতে এবং ওর সঙ্গে কথা বলতে আমি রীতিমতো ভয় পাচ্ছি। আমি ওর মতো এক কিশোরের সঙ্গে মঞ্চে থাকতে পেরে আনন্দিত। এছাড়া, বিদেশী ডেলিগেটদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন, ঈদের নামাজ আদায় যোগ করেছিল আনন্দের নতুন মাত্রা। ডিপ্রজন্ম - অগ্রগাহী সম্পর্কে জানতে চাই- তানযীল - অগ্রগ্রাহী একটি সামাজিক সংগঠন। সবাই বলে তরুণরা কাজ করবে, কিশোররা কেন? কিন্তু কিশোররাও যে সমাজের জন্য কাজ করে তা আমরা করে দেখিয়েছি। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি কিশোরদের চেইঞ্জমেকার হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখার তাগিদের যাত্রা শুরু হয়। ওইদিন আমাদের বিজয় দিবস। পাশাপাশি ওইদিন আমারও জন্মদিন। ঈদে পথশিশুদের কাপড় দিয়েছি, তাদের হাতে মেহেদী লাগিয়েছি, শীতে গরিবদের গরম কাপড় দিয়েছি, নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, কিশোরদের নিয়ে ম্যাগাজিন করেছি, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু পীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছি, বন্যা ও হাওড়ের মানুষদের ত্রাণ দিয়েছি, ক্যান্সার প্যাশেন্টদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে সহযোগিতা করেছি, কোবানীতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে মাংস খাইয়েছি ইত্যাদি কাজ করেছি। গত ২.৫ বছরে ২৩ টির অধিক ইভেন্ট করেছি। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা - ২০৩০ কে সামনে রেখে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের জন্য চেইঞ্জমেকার তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন গোল নিয়ে আমরা কাজ করার প্ল্যান করছি। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে হেলথি টিফিন কার্যক্রম, টিনদের জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্ম, গ্লোবাল কিছু ক্যাম্পেন এবং গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের প্ল্যান রয়েছে। সম্প্রতি অশোকা বাংলাদেশের এই টিন ভেঞ্চারটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ডিপ্রজন্ম - ভবিষত পরিকল্পনা কি? তানযীল- যেই সেক্টরগুলোতে কাজ করছি ভবিষ্যতে আরও ভাল এবং পরিণত কাজ করতে চাই। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে কাজের মাধ্যমে আরও প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। পৃথিবীতে অনেক সমস্যা, যার পরিবর্তন করতে হবে মানুষকেই। তাই চেইঞ্জমেকার তৈরির লক্ষ্যে কাজ করব, সেই সঙ্গে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার টেকসই সমাধান প্রয়োগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু আইডিয়া রয়েছে, যেগুলোর জন্য কাজ করছি। আইডিয়াগুলো ভালভাবে দাঁড়ালেই প্রয়োগ করব। কিশোরদের সুযোগ এবং প্ল্যাটফর্মের অভাব। সেই লক্ষ্যে প্রজেক্ট ডিজাইনিংয়ের কাজ করছি। এছাড়া সানজিদুল আলম ভাইয়্যার একটি উদ্যোগ ও ইনোভেশন হাব খুব শীঘ্র্রই শুরু হতে যাচ্ছে। যেখানে সেসব তরুণ যারা ভিন্নপথে হেঁটে পরির্তনের জন্য উদ্ভাবনী কিছু করতে চায়, হোক সেটা উদ্ভাবনী স্টার্টাপ বা অলাভজনক কাজ, তাদের মেন্টরিং, স্ট্র্যাটেজিক এবং ফান্ডিংয়েয় মতো বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করার একটা প্লাটফর্ম দেয়া হবে। থাকবে ভিন্নধর্মী চিন্তাধারার তরুণদের একসঙ্গে এসে ব্রেইনস্টোর্মিং, নেটওয়ার্কিং করার সুযোগ। এই প্লাটফর্মের ও চ্যাঞ্জমেকার্স হাব নামে একটি সেগমেন্টে আমি মেন্টর হিসেবে আমারই বয়সী তরুণদের আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে মেন্টর হিসেবে সহায়তা করব। সর্বোপরি, দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য ভবিষ্যতে কাজ করতে চাই যেগুলো সমাজ ও ব্যক্তির উন্নয়নে অবদান রাখবে। ডিপ্রজন্ম- বাংলাদেশের কিশোরদের জন্য কোন পরামর্শ- তানযীল - সমাজ, দেশ, মানুষকে ভালবেসে সমাজ, সর্বোপরি দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। ভাল উদ্যোগে বাঁধা আসবে এটাই চিরচারিত নিয়ম। সব বাঁধাকে ডিঙিয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। সুন্দর বাংলাদেশ যদি আমরা গড়তে চাই তাহলে অনেক সুন্দর মনের মানুষ দরকার। নিজেদের সুন্দর মনের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। নিজ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতিকে ভালবেসে পতাকাকে বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করার জন্য কাজ করতে হবে। আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করুন, নিজ দেশকে, দেশের মানুষকে ভাল রাখবেন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কথা বলবেন, অধিকার নিয়ে কথা বলবেন, দেশ, সমাজ নিয়ে ভাববেন, ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলবেন আর আনন্দ ছড়িয়ে দিবেন মানুষের মাঝে। আর চলার পথে এমন কাউকে মেন্টর হিসেবে নিবেন, যিনি নিজেই একই পথে হেঁটে সফল। সে পথে হাতে গিয়ে যে চোরাই উৎরাই পার করেছেন, সে অভিজ্ঞতা থেকে আপনার চলার পথ সহজ করার সহায়তা করে যেতে পারবেন তিনি। যোগ্য মেন্টর খুঁজে নেয়া সফল হওয়ার মূল সূত্রগুলোর একটি। আর সবসময় বিনয়ী হয়ে সবার পরামর্শ নিয়ে দেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। দেশটাত আমাদেরই? তাই না। নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে চলুন নিজেরাই সুন্দর দেশ গড়ি।
×