ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

স্মরণে নিসর্গের সন্তান দ্বিজেন শর্মা

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্মরণে নিসর্গের সন্তান দ্বিজেন শর্মা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তার জীবনটা ছিল সাধু-সন্তদের মতো। জাগতিক লোভ-লালসায় আকৃষ্ট হননি কখনোই। নিবিড়ভাবে ভালবেসেছিলেন প্রকৃতিকে। সেই প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের বন্ধন গড়েছিলেন। এভাবেই নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মাকে মূল্যায়ন করলেন বিশিষ্টজনরা। তাঁর স্মরণানুষ্ঠানে বক্তারা মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (বোটানিক্যাল গার্ডেন) দ্বিজেন শর্মার নামে নামকরণ করার প্রস্তাবও রাখেন। সোমবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। স্মরণের এ আয়োজনে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী ড. দেবী শর্মা, অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ইনাম আল হক, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালক প্রতিভা মুৎসুদ্দী, এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদার, তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেন প্রমুখ। আয়োজনের শুরুতে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন নির্মিত দ্বিজেন শর্মার জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর দ্বিজেন শর্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালন করা হয় নীরবতা। মৌনতা শেষে ভেসে বেড়ায় গানের সুর। নিসর্গবিদের প্রতি ভালবাসা জানিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা। সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ ও ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’ শিরোনাম দুটি। আনিসুজ্জামান বলেন, শুধু প্রকৃতিপ্রেমিক বললে দ্বিজেন শর্মার পুরো পরিচয় দেয়া হয় না। তিনি প্রকৃতি ও মানুুষের জীবনের মধ্যে সুষম সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন এবং মানুষের জন্য একটি সুষম সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। তার সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের প্রত্যেককে তিনি প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন, সচেতন করেছেন। তিনি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি ন্যায়পরায়ন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার কর্ম,গ্রন্থাবলী রেখে গেছেন। আমরা তা থেকে প্রেরণা নিয়ে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। দেবী শর্মা বলেন, বড়লেখার কাঠালতলিতে তার জন্মস্থানে নাগেশ^রী গাছের তলায় তার চিতাভষ্ম, পরিধেয় থেকে সবকিছু সমাহিত করেছি। আমার শাশুড়ি মগ্নময়ী দেবীর কোলে তিনি সমাহিত হলেন, তার জীবনবৃন্ত পূরণ হলো। অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ, তিনি আমার পরিবারের একটি অংশ ছিলেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। শামসুজ্জামান খান বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের গভীর সম্পর্ক, চিন্তার বিন্যাস অনুসরণীয় ছিল। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, জীবনের বহুমাত্রিকতা আমরা দেখেছি। নিসর্গবিদ, লেখক, শিক্ষকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে কোন একটিতে যদি কোন মানুষ শীর্ষে উঠতে পারেন, তাকে আমরা গুণী মানুষ বলি। তিনি নিভৃতে সব অঙ্গনে কাজ করে শীর্ষে গেছেন, তাকে কি বলে অভিহিত করা যেতে পারে, তা আমার জানা নেই। মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, তিনি আমার শিক্ষক, গুরু। ছাত্র হিসেবে কতটুকু শিখেছি জানি না, তবে প্রকৃতির বিষয়ে যতটুকু শিখেছি, তার পুরোটুকুই তার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি নিজেই ছিলেন একটা বটগাছ, সে ছায়া এখন সরে গেছে। সে অভাব কখনও পূরণ হওয়ার নয়। ইনাম আল হক বলেন, শ্যামলী নিসর্গ নির্মাণে তিনি নান্দনিকতার আশ্রয়সন্ধানী হয়ে সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার কথা বলে গেছেন। মোকাররম হোসেন বলেন, তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন হাওড়, বিল, নদী-নালায়। আবিষ্কার করেছেন প্রকৃতির নানা উপাদানকে। নিজে যেমন নিসর্গপ্রেমী ছিলেন, তেমনি তার ছাত্রদের মধ্যেও সৃষ্টি করেন নিসর্গপ্রেম। এ সময় তিনি মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানকে দ্বিজেন শর্মার নামে নামকরণের প্রস্তাব রাখেন। তিনি আরও বলেন, দ্বিজেন শর্মার পরিচয় বহুধাবিস্তৃত। বাংলায় নিসর্গসাহিত্য তাঁর হাতে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। তাঁর শ্যামলী নিসর্গ, গাছের কথা ফুলের কথা, গহন কোন বনের ধারে, কুরচি তোমার লাগি, প্রকৃতিমঙ্গল ইত্যাদি বইপত্র এক নতুন গদ্য ও ভাবনারীতির পরিচয়বহ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ স্মরণানুষ্ঠানে সহযোগিতা করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, ডিসকাশন প্রজেক্ট, তরুপল্লব, নটরডেম নেচার স্টাডিজ ক্লাব, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও অভিযাত্রী। ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন দ্বিজেন শর্মা। চিত্রকে সুদীপ রায়ের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী বিমূর্ত আঙ্গিকে চিত্রকর্ম সৃজনে সিদ্ধহস্ত এক চিত্রশিল্পী সুদীপ রায়। তবে ভারতীয় এই চিত্রকরের মূর্ত আঙ্গিকে আঁকা চিত্রকর্ম যেন আরও বেশি উপভোগ্য। দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্যকল্প মেলে ধরা সেসব চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ পেল রাজধানীর শিল্পানুরাগীর। ক্যানভাসে উঠে এসেছে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠা ভোরের সড়ক থেকে নদীর তীর। বেনারসের নদীতীরের সঙ্গে যেন মিলে গেছে কলকাতার ভোরের সড়কচিত্র। সোমবার থেকে ধানম-ির গ্যালারি চিত্রকে শুরু হলো এই শিল্পীর ৫৫তম একক প্রদর্শনী। সোমবার সন্ধ্যার এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। উপস্থিত ছিলেন শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা ও শিল্পী মুনীরুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন চিত্র সমালোচক অধ্যাপক মইনুদ্দীন খালেদ। এই প্রথম বাংলাদেশ সফর করছেন সুদীপ রায়। সেই সুবাদে তার চিত্রপটে উঠে এসেছে শহর ঢাকারও কিছু চিরাচেনা রূপ। ঢাকার রিক্সা, মসজিদ ও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভবনের ছবিও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকার ছবি দেখেছি ইন্টারনেটে। তাছাড়া ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি। প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম প্রসঙ্গে শিল্পী সুদীপ রায় বলেন, ফেলে আসা জীবন আমাকে টানে। সেসব ছবিতে ধরে রাখতে চাই। তাছাড়া মানুষের জীবনের অবসর এবং কাজের সময়টাও আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। তা তুলে আনতে চেষ্টা করি ক্যানভাসে। তার কথার রেশ মেলে ক্যানভাসে। বিশ্রামরত নারীর অনাবৃত শরীর, কলকাতার চায়ের দোকান, মাটির ভাঁড়, বেনারসের নদীর ধারে সাধু, প-িতের মুখ যেমন উঠে এসেছে। পাশাপাশি উঠে এসেছে বেনারসের প্রাচীন ভবনের ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীর, খিলান, টাঙ্গা প্রভৃতি। ধানম-ির ৬ নম্বর সড়কের গ্যালারি চিত্রকে এ প্রদর্শনী চলবে ২ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮ঠা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্মারক বক্তৃতা সোমবার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী স্মারক বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। বিকেলে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত আয়োজনে এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। একক বক্তৃতায় আবুল মোমেন বলেন, মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন কবি ও কর্মী। অমর একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি লিখে তিনি বাংলা কবিতাভুবনে চির-অমরতা অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে অতিতরুণ বয়সে সীমান্ত পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ তাঁর অসামান্য কীর্তি। এই পত্রিকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা গত শতকের পঞ্চাশের দশকে দুই বাংলাতেই ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় যেমন প্রগতিশীল কবি-লেখকরা লিখেছেন তেমনি তাঁর উদ্যোগে পাকিস্তান আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্মেলন পূর্ববাংলার ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক চৈতন্যকে বৃহৎ পরিসরে উপস্থানে ভূমিকা রেখেছে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশে জীবনের শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে উদার-অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আনিসুজ্জামান বলেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক সক্রিয়তায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী যেমন সম্মুখভাগে ছিলেন তেমনি সাংস্কৃতিক জাগরণের লড়াইয়েও নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় তাঁর বলিষ্ঠ অবস্থান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। শামসুজ্জামান খান বলেন, মাহবুব উল আলম চৌধুরী একজন মৃত্তিকালগ্ন কবি এবং দায়বদ্ধ সংস্কৃতি-সংগঠক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
×