ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

চলতি সপ্তাহেও রাজধানীবাসীর প্রচ- গরমে হাঁসফাঁস দশা। ছত্রিশ ছুঁইছুঁই তাপমাত্রা। তবে বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গরম আটকে থেকে রাতের বেলা আরও বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়। বাতাস চলাচলে সীমাবদ্ধতা আছে যে সব ফ্ল্যাটে তার বাসিন্দাদের কষ্ট বেশি। যাদের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র রয়েছে তারা কিছুটা রক্ষা পাচ্ছেন। তবে বলাবাহুল্য এতে ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত আশ্বিনে এসি ব্যবহার করার তেমন প্রয়োজন পড়ে না ঢাকায়। ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। অবশ্য এখন ঢাকার বহু এলাকাই প্রায় লোডশেডিংমুক্ত। তাই সেদিক থেকে বিচার করলে কিছুটা স্বস্তি মিলছে। পাশাপাশি সত্যপ্রকাশের দায়বোধ থেকে একথাও বলতে হবে যে, কয়েকদিন হলো লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছেন ঢাকাবাসী। লাখ লাখ এসি অ-মিতব্যয়িতার সঙ্গে ব্যবহৃত হলে, এমনটা হওয়া আর অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। আশ্বিনের কথা ওঠায় অবধারিতভাবে আরবী মাস মহররমের কথা এসে যায়। মহররম মানে চান্দ্র বছরের প্রথম মাসও। আর দশই মহররম পবিত্র আশুরা। আশুরায় ঢাকায় তার্জিয়া মিছিল বের হয়। আশুরা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা কাছাকাছি সময়েই হচ্ছে। পূজার প্রতিমা গড়ার চূড়ান্ত সময় এটি। পুরনো ঢাকায় এখন প্রতিমা গড়ার কারিগররা প্রচ- ব্যস্ত। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে সুনাম বজায় রেখে চলেছে। ক’দিন পরেই আশুরা ও পূজায় তার আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি হবে বলে বিশ্বাস করি। দীপনপুরে যুগলবন্দী কবি ও আবৃত্তিকার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে পাঠকের। জঙ্গীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল শাহবাগের আজিজ মার্কেটে তার প্রকাশনা কার্যালয়ে। সেই দীপনের ৪৫তম জন্মদিনে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তার স্মৃতির উদ্দেশে উদ্বোধন করা হয়েছে ‘দীপনপুর’Ñ বইঘর। সেখানে বই কেনা যাবে, বসেও পড়া যাবে। খিদে লাগলে খেয়ে নেয়াও যাবে। বেশ ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ। ২৮০০ বর্গফুটের দীপনপুরে একটা কর্ণার আছে শিশুদের জন্য। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত দীপান্তর নামের এই কর্ণারে বসে শিশুরা খেলবে, হুল্লোড় করবে, বইয়ের পাতায় রং করবে। বই পড়া আর রসনার খোরাক মেটাবার জন্য আছে ক্যাফে দীপাঞ্জলি। ভারি খাবারের ব্যবস্থা নেই, আয়োজন আছে স্ন্যাকস, চা, কফির। দীপনপুরে করা হয়েছে ছোট্ট একটা মঞ্চ, নাম দীপনতলা। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন বা কবিতা পাঠের আসরের জন্য যে কেউ এই মঞ্চ ভাড়া নিতে পারবেন। এই তো গত সপ্তাহে এখানেই হয়ে গেল কবিতাকে ঘিরে ‘যুক্ত’ প্রকাশনা সংস্থার ব্যতিক্রমী আয়োজন। আমন্ত্রিত ষোলোজন কবি একটি করে কবিতা পাঠ করেন, পাশাপাশি ওই কবিদের একটি করে কবিতা আবৃত্তি করে শোনান ষোলোজন আবৃত্তিশিল্পী। সুপরিচিত খ্যাতিমান কবিদের পাশাপাশি নবীন-তরুণ এবং নিভৃতে সৌখিন কবিতাচর্চাকারীরাও কবিতা পড়েন। আবৃত্তিকারদের ব্যাপারেও একই কথা বলা চলে। দীপনপুরে বয়ষ্ক ব্যক্তিরা একটু নিরিবিলি পড়তে চাইলে তার জন্য আছে সিনিয়র সিটিজেন কর্ণার। আছে প্রার্থনাকক্ষও। ওয়াশ রুম রয়েছে তিনটি। বসে পড়ার জন্য রাখা হয়েছে পুরনো বইয়ের চমৎকার একটা সংগ্রহ। এই বইগুলো কেনা যাবে না, শুধুমাত্র বসে পড়ার জন্যই রাখা। দীপনপুরে পাওয়া যাচ্ছে পরিচিত প্রকাশনীগুলোর উল্লেখযোগ্য বইগুলো। বিদেশী বইও থাকবে আগামীতে। বইয়ের অর্ডার করে আসা যাবে, এমনকি বাসায় বসে বই পাবার জন্য অর্ডার করা যাবে অনলাইনেও। দীপনপুর শাহবাগ থেকে হাঁটা-দূরত্বেই, কাঁটাবন মোড়ের কাছে ২৩০ এলিফ্যান্ট রোডে, অটবির শো রুমের ওপরতলায়। নদী দিবসে নদীকথা বিশ্ব নদী দিবস গেল রবিবার। দিবসটি সচেতন ঢাকাবাসীদের শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, রাজধানীর চারপাশের চার নদীর মরণদশার কথাই মনে পড়িয়ে দেয়। দখল আর দূষণ কীরকম আগ্রাসী হয়ে হন্তারক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, তারই করুণ শিকার ঢাকার চার নদী। স্পর্শকাতর স্থাপনার কারণে বার বার উদ্যোগ নিয়েও ঢাকার চার নদী দখলমুক্ত করা যায়নি। নদীর বুকে কিংবা পাড়ে উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও উচ্ছেদে গঠিত কমিটির কাজেও নেই বিশেষ অগ্রগতি। এই বিপন্নতা বোধকরি কর্তৃপক্ষের বিব্রত হওয়ারই অপর নাম! উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বটে, তবে সে উদ্যোগের বাস্তবায়ন না হলে সব বৃথা। উদ্যোগ বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চার নদীকে বাঁচানোর জন্য বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও নদীচতুষ্টয়ের মৃত্যুঘণ্টা বেজেই চলেছে। হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে নদীমৃত্য আমাদের চেয়ে চেয়েই দেখতে হবে। এটাকে নদীহত্যা বলাই বোধকরি সঙ্গত। অর্ধ যুগ আগে উচ্চ আদালতের আদেশ বলে পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে চার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলকে ‘পরিবেশগত সঙ্কটাপূর্ণ এলাকা’ (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়াÑইসিএ) ঘোষণার পরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। দখল-দূষণের ধারাবাহিক শিকার ওই চার নদীরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? তবে প্রসঙ্গত বলা দরকার শুধু চার নদী নয়, দেশের বহু নদীই আজ মরণাপন্ন। দখলবাজদের কবলে শুধু রাজধানীর চার নদীই নয়, দেশের অসংখ্য নদীর অস্তিত্ব বিলীন হতে বসেছে। নদীবহুল বাংলাদেশের অসংখ্য নদী দূষণের শিকার হয়ে বিপন্ন বিপর্যস্ত; মানুষের অপরিণামদর্শিতার কারণে বহু নদী ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বিশ্বের আর কোথাও এদেশের মতো এমন নদীহত্যার নজির নেই। বহির্বিশ্বে প্রকৃতির উপহার সংরক্ষণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়া হয়। নদীকে প্রাণবন্ত, দূষণমুক্ত রাখা এবং তার প্রবাহ অবাধ রাখার জন্য রীতিমতো আইন প্রণয়ন হয়। নদীকে কষ্ট দিয়ে যারা প্রকারান্তরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও প্রকৃতির ক্ষতি করছেন, সেইসব মুনাফালোভী শুভবোধহীন ব্যবসায়ীদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। দীর্ঘদিন যাবতই রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণের কথা বলা হচ্ছে। কালে কালে সেই দূষণ এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নদীটির পানি সংশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানের বুড়িগঙ্গার জীর্ণশীর্ণ নোংরা ও দূষণকে মধ্য ইউরোপের রাইন ও লন্ডনের টেমস নদীর দূষণকালীন কৃষ্ণবর্ণ ও মলিনতার সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। টেমস ও রাইনকে যদি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব হয়, তাহলে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চার নদীকেও রক্ষা করা সম্ভব। এখনও সময় আছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নদীর প্রাণ বাঁচাতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। ঢাকা তথা রাজধানী বাঁচানোই শুধু নয়, এটি দেশের হৃৎপি- বাঁচানোরই সাধনা। নানা ভাষা ঢাকা শহর যে এক অর্থে ‘অভিবাসীদের শহর’ তাতে কোন সন্দেহ নেই। ছিন্নমূল, নদী ভাঙ্গনের শিকার ও ভূমিহীন কৃষক এবং ক্ষেতমজুর বা মৎস্য চাষী হয়েও ক্রমশ কর্মহীন- এমন লোকের সংখ্যাই বেশি? নাকি ঢাকার আগন্তুক হিসেবে তারাই সংখ্যাগুরু, যারা চাকরি সূত্রে কিংবা চাকরি সন্ধানে এই নগরের দ্বারস্থ হয়েছে? শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশে ঢাকায় এসে শিক্ষা সমাপণের পর এখানেই থিঁতু হয়ে যাওয়া মানুষও তো লাখ লাখ! ঢাকায় স্বকর্মসংস্থানের সংগ্রামে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে কত বিচিত্র পেশাতেই না জড়িয়েছেন। ঢাকার আদি বাসিন্দারা আছেন, আছে তাদের নিজস্বতাখচিত ভাষা। বরং গত অর্ধশতকের অতি নগরায়ন ও শহর সম্প্রসারণের ফলে তারাই হয়ে উঠেছেন সংখ্যালঘু। দেশের প্রতিটি জেলার মানুষ এই ঢাকাকে নিজের শহর করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ তার প্রতিটি জেলার মানুষের রয়েছে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা, আর ভাষা থাকলে তার উচ্চারণ-বাচন স্বরভঙ্গিও পৃথক হবে। নগরের অলিগলির হকার-ফেরিওয়ালাদের খরিদ্দার শ্রুতি আকর্ষণকারী বয়ান থেকে তাদের শেকড় কিনে নেয়া এমন কঠিন কিছু নয়। এসব থেকে অবশ্য ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যেও প্রকাশিত হতে পারে। কী কর্মস্থলে কী রাস্তার জটলায় কী কোন অনুষ্ঠানে একটু লক্ষ্য করলে নানা ভাষা কানে আসে। সবই একই মায়ের ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। ঢাকার মতো আর কোথায় মেলে এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বদেশী ভাষা! সাড়ে তিন মিনিটে স্মার্ট কার্ড সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়। মঙ্গলবার আমার সাপ্তাহিক ছুটি। সেদিন বেলা বারোটায় পা রাখলাম উত্তরার ১১ নং সেক্টরে স্মার্ট কার্ড বিতরণ প্রাঙ্গণে। মোট চারটি সেক্টরের হাজার হাজার নাগরিকদের স্মার্ট কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে এখান থেকে। এজন্যে মোট চারদিন বরাদ্দ করা হয়েছে। সেই প্রায় এক দশক আগে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছিলাম। সেই পরিচয়পত্রটি হালনাগাদ ও ডিজিটালসম্মত করে প্রস্তুত করা হয়েছে স্মার্ট কার্ড। দেখলাম বেশ সুশৃঙ্খল আয়োজন। কোথায় প্রথমে যেতে হবে তার নির্দেশিকা দেয়া আছে। জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে সেখানকার কর্মী কম্পিউটারের বোতাম টিপলেন। নাম-নম্বর মিলিয়ে নিয়ে একখানা স্লিপ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পশ্চিমদিকের প্রধান কক্ষ। সেখানেও কয়েকজন বসে আছেন কম্পিউটার নিয়ে। স্লিপ দেখে দশ হাতের আঙুলের ছাপ নিলেন, সেইসঙ্গে চোখের মণির ছবিও তুললেন। ব্যস কাজ শেষ। এখন কক্ষের বাইরে গিয়ে জানালার ওধারের লাইনে দাঁড়াতে হবে। লাইনে আমি পেছনে থাকলেও আমার সামনের কয়েকজনের আগেই আমার নাম ডাকা হলো। তার মানে হলো আমি যে ডেস্কে গিয়েছিলাম সেটির কাজ কিছুটা আগেভাগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। পেয়ে গেলাম স্মার্ট কার্ড। সব মিলিয়ে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট! এজন্যে আমার কোন অর্থব্যয়ও হলো না। সরকার বিনামূল্যেই দিচ্ছে এই ডিজিটাল পরিচয়পত্রটি। তবে যারা পুরনো কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেন তাদের অর্থব্যয় করতে হচ্ছে। ব্যাংকে গিয়ে তিনশ’র ওপরে একটা অঙ্কের টাকা জমা দিতে হচ্ছে। ফেরার সময় ভাবছিলাম যার কাছে পরিচয়পত্রের ফটোকপি রয়েছে সেখান থেকে নম্বর মিলিয়ে নেয়া তো কোন সমস্যা নয়। তাহলে তাদেরও কেন অর্থ জমা দিতে হবে? কেননা আগের কার্ডটিও কর্তৃপক্ষ ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন। সেটি যদিও কোন কাজে লাগবে না। এখন থেকে নানা প্রয়োজনে এই স্মার্ট কার্ডটিই সরাসরি ভূমিকা রাখবে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ [email protected]
×