ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুড়িগঙ্গাকে বাঁচান

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বুড়িগঙ্গাকে বাঁচান

শেষ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার প্রাণপ্রবাহ বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো গেল না! বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে থাকা তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার অবস্থাও যে ভাল, এমন কথা বলা যাবে না। নদ-নদীর সতত প্রবাহ সর্বদাই একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অবশ্য বুড়িগঙ্গার এহেন করুণ দুর্দশা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বরং গত দু’শ’ বছর ধরেই এককালের প্রমত্তা স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা ক্রমাগত দূষিত ও শীর্ণকায় হয়ে উপনীত হয়েছে বর্তমান অবস্থায়। ঐতিহাসিক নগরী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার সকরুণ দুর্দশার চালচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের একটি পত্রিকায়। নদী সুরক্ষায় কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৮৬৬ সালে। যেখানে বলা হয়েছিল বুড়িগঙ্গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে পানির প্রবাহ। অন্যদিকে যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হওয়ায় দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। তৎকালীন কবি নবীনচন্দ্র সেনের একটি লেখায় পাওয়া যায়, শ্রীমতী বুড়িগঙ্গার কলেবর এত সঙ্কীর্ণ যে, তা অতিক্রম করার জন্য গামলারও প্রয়োজন হয় না। এ থেকেই দখল-দূষণে বিশীর্ণ হয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার হদদরিদ্র দশা ও চূড়ান্ত সর্বনাশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো না গেলে রাজধানী হিসেবে টিকিয়ে রাখা যাবে না ঢাকাকেও। বুড়িগঙ্গা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে দীর্ঘদিন থেকে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে, রাজধানী হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে যে কোন মূল্যে, যে কোন উপায়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে বুড়িগঙ্গাকে। মানবসভ্যতা সর্বদাই নদ-নদীকেন্দ্রিক। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করা সত্ত্বেও যেটা দুঃখজনক ও মর্মান্তিক তা হলো, ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা এখন মৃতপ্রায়। একে তো শীর্ণ তনু, ততোধিক ক্ষীণ প্রবাহ, বিবর্ণ কালো বর্ণের পঙ্কিল পানি, ভাসমান ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ, অবরুদ্ধপ্রায়। প্রকৃতপক্ষে যা একটি বড়সড় নর্দমা বলেই প্রতিভাত হয়। সেই প্রায় প্রাণহীন স্তব্ধপ্রায় দুর্গন্ধকবলিত বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে কোন স্বপ্ন দেখা দুঃস্বপ্নের নামান্তর বৈকি। তবু বাস্তবতা হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে নিরন্তর। এরই একটি নমুনা বোধকরি বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে আরও একটি হাতিরঝিল নির্মাণের স্বপ্ন। ঢাকা ইনটিগ্রেটেড আরবান ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় নেয়া হয়েছে এই প্রকল্প। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করবে বিশ্বব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। পরামর্শ সংস্থা নিয়োগও চূড়ান্তপ্রায়। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে শিকদার মেডিক্যাল থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ের আধুনিকায়ন, দু’পাশে সিরামিকের তৈরি ওয়াকওয়ে, পর্যটকদের জন্য বিনোদন সুবিধা সংবলিত বিলাসবহুল প্রমোদতরী, বিনোদন পার্ক, অবকাশ যাপনের জন্য আলিশান রিসোর্ট, হোটেল-রেস্তরাঁ সর্বোপরি সর্বাধুনিক নৌবন্দর ও টার্মিনাল। উপরোক্ত পরিকল্পনা যে খুব অভিনব, আকর্ষণীয়, চিত্তাকর্ষক ও দুর্দান্ত, একথা বলতে হবে এক বাক্যে। তবে এর জন্য সর্বাগ্রে যা করণীয় তা হলো একদার কল্লোলিনী স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গার পরিপূর্ণ পুনরুদ্ধার, যা এক কথায় দুরূহ ও অসম্ভব। কেননা, ভূমিগ্রাসীদের অবৈধ হিংস্র থাবায় ইতোমধ্যেই বুড়িগঙ্গার দুই তীরের অধিকাংশ জমি চলে গেছে বেদখলে। সেসব স্থানে গড়ে উঠেছে বড় বড় অসংখ্য স্থাপনা ও বহুতল ইমারত। সময় সময় সে সবের কিয়দংশ লোক-দেখানোভাবে উচ্ছেদ করা হলেও অচিরেই তা চলে যায় দখলদারদের কবলে। কোন কোন স্থাপনা উচ্ছেদ স্পর্শকাতরও বটে। সেক্ষেত্রে দু’পাশের অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা না গেলে নদীর প্রবাহ অক্ষুণœ রাখা সম্ভব হবে না কিছুতেই। মনে রাখতে হবে এক সময় বৃষ্টি ও বর্ষার মৌসুমে বুড়িগঙ্গার দু’কূল প্লাবিত হতো। দু’তীরে ছিল সবুজে সবুজ, শ্যামলে শ্যামল। শুভাঢ্যা-কেরানীগঞ্জে হতো চাষবাস। জেলেরা মাছ ধরত। বর্তমানে সেই বুড়িগঙ্গা কেবলই দীর্ঘশ্বাস ও দূষণকবলিত। সেক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করাও জরুরী ও অপরিহার্য। বুড়িগঙ্গায় যাবতীয় কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা না গেলে নদী পুনরুদ্ধার অধরাই থেকে যাবে। বুড়িগঙ্গার পানির মান ঠিক রাখতে পরিকল্পনা অনুযায়ী একাধিক রিসাইকেল পন্ড বা পানি শোধনাগার স্থাপন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে যে হাতিরঝিলের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এর মধ্যেই নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেসব বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। বুড়িগঙ্গাকেও সর্বাগ্রে পুনরুদ্ধার করতে হবে, নাব্য পূর্বাবস্থাসহ। এর পরই না হয় অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নির্মাণ, সবুজায়ন, পার্ক ও বিনোদন ব্যবস্থা, থ্রিস্টার-ফাইভস্টার হোটেল! তা না হলে ‘পরি’ ‘কল্পনা’ হয়ে অচিরেই উড়ে যাবে আকাশে! মনে রাখতে হবে যে, লন্ডনের টেমস, প্যারিসের শ্যিন, কলকাতার গঙ্গাও একদার চরম দুর্দশা থেকে পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে বুড়িগঙ্গাই বা হবে না কেন?
×