ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কটের শেষ কোথায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কটের শেষ কোথায়

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা ও সেখানকার সন্ত্রাসীদের হিংসার ছোবল থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি হবে; এটাই এখন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার জান্তার নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছে গত ২৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে। এর আগেও এ ধরনের ঘটনা দফায় দফায় ঘটেছে। কিন্তু এবারকার মতো এত ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়নি। এবার যা হয়েছে তা মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা বিরোধী তৎপরতায় এ পর্যন্ত বড় ধরনের একটি রেকর্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবতা ক্ষতবিক্ষত। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। এরপরও সহিংসতা থামছে না। জাতিসংঘসহ সারাবিশ্ব (গুটি কয়েক দেশ বাদে) সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও মিয়ানমার সরকার রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করছে না। বিশ্ব যতই সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক না কেন, এ সমস্যা মিয়ানমার সরকার সৃষ্টি করেছে; এর সমাধানও সে দেশের সরকারের আন্তরিকতার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন মানুষে পরিণত করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার তিন শ্রেণীর নাগরিকত্বের ঘোষণা দিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা লুপ্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সে দেশের আইনে রয়েছে তাইরেন্স, নাইংচা এবং নাইংক্রাচা। অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, প্রকৃতগত নাগরিক এবং অতিথি নাগরিক। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিল। তারা সে দেশের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বও করেছে। কিন্তু জান্তা সরকার একে একে সবই কেড়ে নিয়েছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তমুখী হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রথম কয়েকদিন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধের চেষ্টা চলে। কিন্তু ঢলের মতো রোহিঙ্গা আগমনের ঘটনা শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ সীমান্ত দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত শনিবার থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এখনও আসছে। জীবিতদের পাশাপাশি সাগর ও নাফ নদে ভেসে এসেছে বহু রোহিঙ্গার লাশ। পচে-গলে একাকার হয়ে গেছে রোহিঙ্গা মানবদেহ। সীমান্তে সৃষ্টি হয় মানবিক বিপর্যয়। অপরদিকে, রাখাইন রাজ্যে সেনা বর্বরতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশু। পৈশাচিক কায়দায় রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা এখনও রেহাই পাচ্ছে না সেখানকার সেনা ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। পুরো রাখাইন রাজ্য হয়েছে অগ্নিগর্ভ। এ যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার মানবিক পথ বেছে নিলেও এ সমস্যা যে দীর্ঘস্থায়ী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী সন্ত্রাসী ও জঙ্গী’ আখ্যায়িত করেছে। সর্বশেষ বলেছে, রোহিঙ্গারা কেন রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তা তারা তদন্ত করে দেখবে। এছাড়া গত ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে কোন সামরিক অভিযান চলেনি বলেও মিথ্যাচার করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গণতন্ত্রমনা ও একজন নোবেল বিজয়ী যিনি সে দেশের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন সেই আউং সান সুচির মুখ থেকে যখন এ ধরনের মিথ্যাচার চলে তখন স্বাভাবিকভাবে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে যায়। হয়েছেও তাই। শুধু চীন, ভারত ও রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশ মিয়ানমার সরকারের এ বর্বরতম রোহিঙ্গাবিরোধী আচরণকে সমর্থন দেয়নি। খোদ জাতিসংঘ এবং শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের পক্ষেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের নিন্দা জানানো হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান রয়েছে সর্বাগ্রে। তবে দেরিতে হলেও আরব জাহানের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খোলা হয়েছে। দাবি জানানো হয়েছে রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে। এ ইস্যুতে এ পর্যন্ত জাতিসংঘসহ কোথাও মিয়ানমারকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা যায়নি। মিয়ানমার ‘একলা চল’ নীতিতেই এখনও অটল রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা নিধন-নিপীড়নও অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগামীতে কি হবে বা হতে যাচ্ছে তা এখনও বলা মুষ্কিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মিযানমারের সহিংস এ ঘটনার জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এছাড়া আগামীতে বিষয়টি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলেও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে। যদিও সর্বশেষ মিয়ানমারের পক্ষে ঘোষণা করা হয়েছে তারা যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। প্রশ্ন্ উঠেছে, কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, আর শেষ পর্যন্ত তারা কতজনকে ফিরিয়ে নেবে বা আদৌ নেবে কি না? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এখনও সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করেনি। তবে দ্বিতীয় দফায় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবান করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুটির সমাধান যে অসম্ভব তা সকলেরই জানা। এছাড়া শক্তিধর রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আছে। এসব দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থেই তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষ না নিয়ে মিয়ানমারের সমর্থনে থাকার ঘোষণা দিয়ে আছে। সঙ্গত কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি হবে-তা নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম নিয়েছে।
×