ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উৎসবের আগেই উৎসব শাঁখারী বাজারে

ঐতিহ্যবাহী শাঁখা শিল্পের নিদর্শন, পূজার সামগ্রী রঙিন কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঐতিহ্যবাহী শাঁখা শিল্পের নিদর্শন, পূজার সামগ্রী রঙিন কেনাকাটা

মোরসালিন মিজান শাঁখারীবাজারের সরু গলি। ছোট ছোট ঘর। কিন্তু আয়োজন বড়। এতো বড় যে, দেখে মনে হয় শুরু হয়ে গেছে দুর্গোৎসব! সর্বত্রই একটা সাজ সাজ রব। শাঁখা শঙ্খ তো আছেই, হরেক রকমের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। প্রতিমা থেকে শুরু করে দেবীর শাড়ি গহনা সব পাওয়া যাচ্ছে। আছে পূজার সামগ্রী। সারাদেশ থেকেই আসছেন ক্রেতা। আর ঢাকার উৎসবপ্রিয় বাঙালীর কথা তো বলাই বাহুল্য, মধ্যরাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। কী যে আলোকজ্জ্বল রাত! মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। এভাবে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগেই রং ছড়াচ্ছে শাঁখারীবাজার। শাঁখারীরা এখানে বহুকাল ধরে একত্রে বসবাস করছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে মুঘলদের সঙ্গে ঢাকায় আসেন শাঁখারীরা। সেই থেকে এখনও একই জায়গায় আছেন। পারিবারিক পেশা ধরে রেখেছেন অনেকেই। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে নানা কিছু। এখন তারা বাড়ির ওপরের তলায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। আর নিচে দোকান সাজিয়ে নিয়েছেন। মূলত পূজার সামগ্রী দিয়ে ঠাসা দোকানগুলো অনেক রাত পর্যন্ত জমজমাট থাকছে। শনিবার রাত ৯টার দিকে শাঁখারীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, দিনের মতোই মুখরিত। উৎসবের একটা আমেজ। গলির প্রায় পুরোটাজুড়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। কয়েক কদম পর পর নির্মাণ করা হচ্ছে অস্থায়ী ম-প। বাঁশের তৈরি অবকাঠামোর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল শঙ্খ শিল্প কারিগর সমিতির অফিস। অফিসের সামনের খোলা জায়গায় বসে আপন মনে কাজ করছিলেন এক শাঁখারী। নাম স্বপন। নিজস্ব কায়দায় শাঁখার ওপর পাথর বসাচ্ছিলেন তিনি। বয়সে তরুণ কারিগর বললেন, বাপ দাদার পেশা। তাই এখনও করি। পূজার সময় চাহিদা বেড়ে যায়। তাই অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আজ ও আগামীকাল পর্যন্ত এই ব্যস্ততা থাকবে বলে জানান তিনি। রাস্তার দুই পাশের দোকানগুলোও বেশ জমজমাট। দিনের মতোই ভিড় করে ছিলেন ক্রেতা। নারীরা সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিলেন শাঁখা কেনায়। নক্সাগুলো ভাল করে দেখে নিয়ে হাতে পরছিলেন, খুলছিলেন। লক্ষ্মী ভা-ার নামের একটি দোকানে ঢুকে দেখা গেল, মেঝেতে চৌকি পাতা। তার ওপর শাঁখা ছড়িয়ে দিয়ে গুণাগুণ বর্ণনা করছেন কর্মচারীরা। নারীরাও এটা ওটা জিজ্ঞেস করে সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করছেন। এর এক ফাঁকে দোকানের মালিক অমিয় কুমার সুরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দোকানটি ৬০ থেকে ৭০ বছরের পুরনো! আগে তিনি নিজে কাজ করতেন। এখন কারিগর দিয়ে করান। অন্য দোকানগুলোতে প্রতিমা সাজানোর সামগ্রী। শাড়ি। গহনা। দেখে মনে হয়, যে কেউ ব্যবহার করতে পারবেন। আসলে প্রতিমার জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা। দত্তা ভা-ার নামের একটি দোকানে রঙিন শাড়ির বড় সংগ্রহ। প্রতিটি শাড়িতে চুমকি, কারচুপি, সুতার সুন্দর কাজ করা। প্রতিমার মাপ অনুযায়ী কেটে বিক্রি করা হয়। প্রতিমার গলায় পরানোর মালা, হাতের অস্ত্র ইত্যাদিও যথারীতি আছে। বিক্রেতা বিষ্ণু বলছিলেন, প্রতিমা গড়ার পর সবাই সাধ্যমতো তাদের সাজিয়ে নেন। আমরা সেদিকটি বিবেচনায় রাখি। দুর্গাসহ সকল দেব দেবীর সাজ সজ্জা সামগ্রী তাদের এখানে আছে বলে জানান তিনি। প্রতিমার মাথায় পরানোর মুকুটগুলো বিশেষ আকর্ষণীয়। খুব নজর কাড়ে। জরি পুঁতি পাথর বসানো মুকুট রাতের বেলায়ও ঝলমল করছিল। মা বাসন্তী ভা-ার নামের একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচ ছয়জনের মতো কারিগর। সবাই ব্যস্ত। চোখের সামনে কাগজ কাটছেন। তার ওপর আঠা দিয়ে পুঁতি পাথর জরি বসানোর কাজ করছেন। দেখতে দেখতেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে মুকুট। দোকানের মালিক শঙ্কর সরকার বললেন, মুকুট প্রতিমার সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। গুরুত্বটাও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। মুকুটেরও আছে নানা নাম। এই যেমন বাংলা চূড়া, অরিয়েন্টাল, লক্ষ্মী বাংলা ইত্যাদি। শাঁখারীবাজারে খুঁজে পাওয়া যায় কাঁসা ও পিতল শিল্পের নিদর্শন। কাঁসার তৈরি ছোট ছোট ঘটি-বাটি পূজায় ব্যবহার হয়। আছে ধূপতি, ঘণ্টা, পঞ্চ প্রদীপ। নাগ ভা-ারের বিক্রেতা পল্লব জানান, এগুলো ছাড়া পূজা করা যায় না। তাই দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বাজার ঘুরে দেখা গেল শোলা শিল্পের নানা নিদর্শনও। উৎসব সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়েছে। দামে কম। বিক্রিও হচ্ছে ভাল। বিভিন্ন দোকানে আছে ‘স্পেশাল মিষ্টি।’ পটকা ঘুড়ি বাদ্যযন্ত্র সুগন্ধীÑ কী নেই? সব মিলিয়ে উসবমুখর শাঁখারীবাজার। দুর্গোৎসবের আগেই উৎসবের রংটা দেখতে হলে একবার ঘুরে আসতে পারেন বৈকি!
×