ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

মামলাজট কমাতে ঢাকার সিএমএম কোর্ট হতে পারে রোল মডেল

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মামলাজট কমাতে ঢাকার সিএমএম কোর্ট হতে পারে রোল মডেল

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিচার বিভাগের কাঁধে প্রায় ৩১ লাখ মামলার ভার। অর্থাৎ দেশের আদালতগুলো যেন মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। তবে মামলাজট কমাতে তথা মামলা নিষ্পত্তি করতে সঠিক সময়ে সঠিক কর্মকৌশল গ্রহণসহ তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটালে এবং সর্বোপরি নিরলস ও আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে সহজেই যে মামলাজট দূর করা যায়। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) কোর্ট। ঢাকার মাননীয় সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমান ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট সিএমএম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক বছরের মাথায় তার নেতৃত্বে প্রায় সোয়া দুই লাখ মামলা নিষ্পত্তি করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। উল্লেখযোগ্য হারে মামলা নিষ্পত্তির পাশাপাশি ঢাকার সিএমএম কোর্টে দালাল-টাউটদের দৌরাত্ম্য কমানো, আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রেকর্ড সংরক্ষণ, নকল (মামলা সংক্রান্ত কপি) সরবরাহ, মালখানা ব্যবস্থাপনাসহ নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমান সিএমএম যোগদানের সময় ওই কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৪১৮টি। মামলার শ্রেণী ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে তার নেতৃত্বে দ্রুত ওই মামলাসমূহ নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়। ফলে ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৯৫ হাজার ৯২২টি মোটরযান মামলাসহ মোট ১ লাখ পনের হাজার ৭৫৪টি মামলা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয় ঢাকাস্থ সিএমএম আদালত। অপর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ঢাকার সিএমএম কোর্টে মোট নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ এক হাজার ১৪৯টি। আর ২০১৫ সালে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮০৮টি। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট বর্তমান সিএমএম দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে চলতি বছরের (২০১৭) জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ২২১টি। মামলা নিষ্পত্তির এ ধারাবাহিকতা বর্তমানেও বহমান রয়েছে। ঢাকার সিএমএম কোর্টের উদ্যোগে বর্তমানে জামিন, রিমান্ড শুনানিসহ বিভিন্ন আমলি আদালতের প্রাত্যহিক বণ্টন সম্পর্কিত তথ্যাদি সিএমএম কোর্টে রক্ষিত মনিটর ও নোটিস বোর্ডের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী জনগণকে প্রতিদিন অবহিত করা হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকার সিএমএম কোর্টের উদ্যোগে ওই কোর্টে অন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: ১. আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ওই আদালতে ১৬টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন; ২. বিভিন্ন আদালতের কম্পিউটার কম্পোজকৃত রায় ও আদেশের সই মহুরি নকল চাওয়া মাত্র দেয়ার লক্ষ্যে সার্ভার স্থাপন; ৩. বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনলাইন সার্ভারে সিএমএম কোর্টের মামলার ফলাফল যথাসময়ে প্রতিনিয়ত পোস্ট করার ব্যবস্থা গ্রহণ; ৪. ওই ম্যাজিস্ট্রেসিতে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত ডাটাবেজ প্রস্তুতকরণ; ৫. বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ওই ম্যাজিস্ট্রেসির জন্য স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট খোলার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ; ৬. মামলার শুনানির সুবিধার্থে সিএমএর-এর এজলাসসহ মোট তিনটি এজলাসে মাইক্রোফোন স্থাপন; ৭. আদালতের মূল ভবনে আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের উঠা-নামার সুবিধার্থে কার্গোলিফট স্থাপন; ৮. পেন্ডিং মামলার আলামত সপ্তাহে তিনদিন নিয়মিতভাবে ধ্বংস করা এবং আলামত সুষ্ঠুভাবে ধ্বংসের সুবিধার্থে চুল্লি স্থাপনের কার্যক্রম গ্রহণ; ৯. রেকর্ডরুমের আধুনিকায়ন করা, সংশ্লিষ্টদের একটি পূর্ণাঙ্গ রেজিস্ট্রার তৈরিকরণ এবং রেকর্ড সম্পর্কিত তথ্যাদি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ; ১০. সিএমএম আদালতের হাজতখানায় কয়েদিদের জন্য নিরাপদ পানি এবং শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পান কক্ষ নির্মাণ; ১১. হাজতিদের পরিচ্ছন্ন বাথরুম সুবিধা নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ; ১২. মাসিক Disposal Meeting-এর মাধ্যমে সিএমএম কোর্টের প্রত্যেকটি কোর্টের মাসিক Disposal Report পর্যালোচনা ও মূল্যায়নপূর্বক অধিকতর মামলা নিষ্পত্তির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের উৎসাহ ও তাগিদ প্রদান করা; ১৩. ওই ম্যাজিস্ট্রেসির গুরুত্বপূর্ণ শাখাসমূহ (যেমন: নকলখানা, মালখানা, নেজারত, রেকর্ডরুম, এফিডেভিটসহ অন্য বিভাগ) নিয়মিত পরিদর্শনপূর্বক সমস্যা চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; ১৪. সিএমএম আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক সময়ে আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আদালতে ডিজিটাল এটেনডেন্স মেশিন স্থাপনকরণ; ১৫. বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ লাঘবকল্পে আদালতে দুটি হেল্পডেস্ক খোলার উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি। তবে ঢাকার বর্তমান সিএমএম শেখ হাফিজুর রহমানের যে অভিনব উদ্যোগটি সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে, তা হচ্ছে জনসাধারণের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তিনি প্রতিদিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেটদের রিমান্ড ও জামিন শুনানির অধিক্ষেত্র পরিবর্তন করেন। প্রতিদিন সকাল ১০টায় বিচার শুরুর পূর্বে পর্যন্ত মামলার কোন পক্ষই জানতে পারেন না যে, তার বা তাদের মামলার বিচার করবেন কোন্ বিচারক। এই অভিনব কৌশলগত পরিবর্তনের ফলে বিচারে অহেতুক হস্তক্ষেপ ও দালাল-টাউটদের দৌরাত্ম্য উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতের উদ্যোগে গৃহীত উপরোক্ত বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে একটি দেশে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। ঢাকার সিএমএম কোর্টের ন্যায় দেশের সকল কোর্ট যদি এই ধরনের কর্মকৌশল অনুকরণপূর্বক গ্রহণও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করে, তবে দেশের কোন আদালতকেই সহজে আর মামলার ভারে ভারাক্রান্ত হতে হবে না বলে আশা করা যায়। লেখক : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক; বর্তমানে ফিলিপিন্সের লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। [email protected]
×