ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্থায়ী সমাধান কাম্য

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্থায়ী সমাধান কাম্য

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে শুক্রবার প্রদত্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবিশেষ প্রশংসিত হয়েছে। এতে তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তভাবে বন্ধ করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে একই সঙ্গে তিনি পাঁচটি প্রস্তাবও পেশ করেছেন। এগুলো হলোÑ সে দেশে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করা; জাতিসংঘ মহাসচিবের অধীনে একটি নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণ; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং তা পূরণে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে, যাদের অধিকাংশ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সর্বোপরি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন ও বাস্তুচ্যুত করার ঘটনা বেশ পুরনো। জাতিসংঘের তথ্য মতে ১৯৬২ সাল থেকে এটি প্রায় নীরবে হলেও চলে আসছে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়। ক্রমাগত শোষণ, বঞ্চনা, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারাও ক্রমাগত দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিবেশী ভারত, চীন, পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও অধিকাংশই নিঃস্ব, রিক্ত, সহায়সম্বলহীন হয়ে ভিটামাটি হারিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশে, প্রধানত টেকনাফ ও কক্সবাজারসহ সুবিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর। জাতিসংঘে মিয়ানমারের উপরাষ্ট্রপতির ভাষণে রোহিঙ্গাদের প্রতি সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন স্থগিতের কথা বলা হলেও বাস্তবতা এই যে, বিশেষ করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের চলে আসা বন্ধ হয়নি। কম-বেশি প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এই স্রোত এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। তবে বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ, বিপুল জনগোষ্ঠী ও স্বল্পপরিসরে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে সমর্থ নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদারতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির কারণে বাংলাদেশ তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়সম্বলহীন শরণার্থীদের জন্য। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের এই ঔদার্য ও মানবিকতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, ভারত, চীন, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে এবং পাঠাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মেসহ অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরা আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়া, চীন ও ভারত এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে খোলাখুলি কিছু না বললেও প্রবলভাবে বিরোধিতা করেনি। বরং ভারত ও চীন ত্রাণ পাঠিয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। ওআইসিও রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেছে। বলতেই হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবারই প্রথম রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি বেশ জোরেশোরে উপস্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে এবং জাতিসংঘে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ৫ দফা সমস্যাটির সুদূরপ্রসারী সমাধানে প্রভূত সহায়ক হতে পারে। এখন জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় কিভাবে এই সমস্যাটি সমাধানে অগ্রসর হয় সেটাই দেখার বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে শান্তি-শৃঙ্খলাসহ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় সাধন করতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এখন যত দ্রুত তারা মিয়ানমারে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসিত হতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে।
×