ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাকৃবির গবেষকের সাফল্য

ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ

মোফাজ্জল হোসেন, বাকৃবি সংবাদদাতা ॥ স্বাভাবিক পশুখাদ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গ্রোথ হরমোন ও এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বাংলাদেশে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণের একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে গবাদিপশু মোটাতাজা করা হলে থেকে যায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি। অতিরিক্ত গ্রোথ হরমোন ও এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো গবাদিপশুর মাংস ও দুধে থেকে যায় এসব ক্ষতিকারক পদার্থেও অবশিষ্টাংশ। যার ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, বৃদ্ধি পায় ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অটিজমসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগের সম্ভাবনা। তাই বিকল্প উপায়ে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ হয়ে ওঠে সময়ের দাবি। গ্রোথ হরমোন ও এ্যান্টিবায়োটিক বিকল্প হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন। গ্রোথ হরমোন বা এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে সাধারণ পশুখাদ্যের সঙ্গে ভেষজ গুণ সম্পন্ন ঘাসের নির্দিষ্ট পরিমাণ সবুজ ঘাস বা ঘাসের পাউডার খাইয়ে গবাদিপশু মোটাতাজা করে মাংস ও দুধের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে তার এই গবেষণা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ বিখ্যাত এ্যানিমাল জার্নালসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা সম্পর্কে ড. মামুন বলেন, গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে বিভিন্ন ধরনের গ্রোথ হরমোন বা এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ওই পশুর দেহের বিভিন্ন এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে গবাদিপশুর দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এর ক্ষতিকারক প্রভাব থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্ব গো-খাদ্যে গ্রোথ হরমোন ও এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী বিকল্প গ্রোথ প্রমোটার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার শুরু হয়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ভেষজ উদ্ভিদ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রীন গ্রোথ-প্রমোটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৪ সালে জাপানের ইউয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন। তখন প্লানটেইন (চষধহঃধমড় ষহপবড়ষধঃধ খ.) নামে নতুন আবিষ্কৃত বহুবর্ষজীবী ঘাসজাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং সফলতা পান। এই ঘাসে সাধারণ ঘাস থেকে অধিক পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’, ‘ই’ ও এন্টি অক্সিডেন্ট আছে। এছাড়াও এতে এমন কিছু বায়োএ্যাকটিভ উপাদান আছে যা সাধারণ ঘাসে নেই। এর এন্টি অক্সিডেন্ট ফ্রি র‌্যাডিকেলের কার্যকারিতা বন্ধ করে প্রাণীদেহের কোষ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে। যার ফলে এটা কোন প্রকার বিরূপ প্রভাব ছাড়াই পশুর শরীর এ্যান্টিবায়োটিক বা গ্রোথ- প্রমোটরের মতো কোন কোন ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি হারে গবাদিপশুকে বর্ধিত করে। এই গবেষণার জন্য তিনি জাপানের সেরা তরুণ গবেষক, ডীন ও প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পান। কিন্তু উদ্ভিদটি শীত প্রধান অঞ্চলের। তিনি চিন্তা করেন কি করে এ ঘাসটি দেশের প্রাণীজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজে লাগানো যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে পিএইচডি ও পোস্টডক শেষ করে দেশে ফিরে উদ্ভিদটি দেশীয় আবহাওয়ায় ব্যবহার করেও সফলতা পান। শীত প্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ হলেও দেশের আবহাওয়ায় শীতকালে ৬০-২৪০ সে. তাপমাত্রায় ঔষধি গুণাগুণ তুলনামূলকভাবে ভাল থাকে। আর ঘাসটি উৎপাদনে বিশেষ কোন অসুবিধা না থাকায় কৃষকরা সহজেই অধিক লাভবান হতে পারবেন বলে তিনি জানান। গবেষণায় দেখা গেছে, ভেষজ গুণসম্পন্ন প্লানটেইন নামক উদ্ভিদ খাইয়ে উৎপাদিত মাংসে চর্বি কম থাকে। একই সঙ্গে ফ্যাটি এসিডের (ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩) অনুপাত কমাতে সহায়তা করে। এতে করে মানুষের হার্ট ভাল থাকে। বয়স ধরে রাখতে সহায়তা করে। মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। ক্যান্সার ও অটিজম প্রতিরোধ করে। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন বলেন, রোমন্থক প্রাণী যেমন গরু, ভেড়ার স্বাভাবিক খাদ্যের সঙ্গে খুব সামান্য পরিমাণে (পোল্ট্রির খাবারে সঙ্গে ১%, ভেড়ায় খাবারের সঙ্গে ৪%, গরুর খাবারের সঙ্গে ৫-১০%) সবুজ প্লানটেইন উদ্ভিদ বা এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর হিট স্ট্রেস কমিয়ে প্রোটিনের সিনথেসিস বাড়িয়ে দেয়। ফলে গবাদিপশু সহজেই মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এটি উচ্চ এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাংসের উৎপাদন, স্বাদ ও রং বৃদ্ধি পায় এবং পচনরোধ করে। এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দেয়। অনেক আগে থেকেইে অর্গানিক পদ্ধতিতে প্রাণীজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রাণীজ খাদ্য হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদ আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে বিশ্ব ঝুঁকে পড়ছে অর্গানিক প্রোডাক্টের দিকে হোক সেটা মাঠ ফসল বা প্রাণিসম্পদ। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাস্থ্য সচেতনতা। এমন সময় গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে সকল ক্ষতিকর হরমোন বা এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করে অর্গানিক পদ্ধতি ব্যবহার সময়ের দাবি।
×