ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাঙ্গলিক ধ্বনিতে জেগে ওঠার অপেক্ষা

উদয় দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে মোর চিত্ত-মাঝে...

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

উদয় দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে মোর চিত্ত-মাঝে...

মোরসালিন মিজান ॥ উদয় দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে/মোর চিত্ত-মাঝে...। চিত্ত মাঝে শঙ্খ এখন বাজছে বৈকি! আর মাত্র কদিন পর শারদীয় দুর্গোৎসব। এ সময় শঙ্খ-ই তো বাজবে। মনের যে আনন্দ উৎসবের যে রং আর কিছুতে এত প্রকাশিত হয় না। মাঙ্গলিক এ ধ্বনি তুলে পূজার শুরু হয়। তাই বলে এটি শুধু পূজার অনুষঙ্গÑ এ কথা বলা যাবে না। আছে নানা ধরনের ব্যবহার। তারচেয়ে বড় কথা, শঙ্খের রয়েছে শিল্পসৌন্দর্য। এর গায়ে করা সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। শঙ্খ একই সঙ্গে কম্বু বা শাঁখ নামে পরিচিত। সামুদ্রিক এক ধরনের শামুকের খোলস দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। গায়ের রং সফেদ সাদা। মসৃণ। শঙ্খের মুখটি বক্রাকার ছিদ্রবিশিষ্ট। ভেতরে ছিদ্রপথটিও বক্রাকার। এর সামনের অংশে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিলে চমৎকার সুর ওঠে। সে বিবেচনায় এটি বাদ্যযন্ত্রও বটে। আকৃতি-প্রকৃতির বিবেচনায় গোমুখ শঙ্খ, ধবল শঙ্খ, পানি শঙ্খ, পঞ্চমুখী শঙ্খ ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয় বাদ্যযন্ত্রটিকে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেন ড. আবদুল ওয়াহাব। তিনি জানান, শঙ্খ বাংলা তথা ভারতের বহু প্রাচীন শুষির শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র। প্রাচীন বাংলার সঙ্গীত আসরগুলোতে শঙ্খতরঙ্গ বাজানো হতো। সাত বা বারোস্বরের সাতটি বা বারোটি শাঁখে আলাদা আলাদা স্বরধ্বনিত করে রাগ বাজানোর কথাও জানান তিনি। এর বাইরে বহু যুগ আগের ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম, পুস্তক ইত্যাদিতে এর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে এর সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়। মহাভারত, রামায়ন ও অন্যান্য পুরাণে শঙ্খের বহু উল্লেখ আছে। সে সময় এর নামেও ছিল বৈচিত্র্য। মহাভারতে কৃষ্ণের শঙ্খের নাম ছিল পাঞ্চজন্য। যুধিষ্ঠিরের শঙ্খের নাম ছিল অনন্ত বিজয়, ভীমের পৌত্র, অর্জুনের দেবদত্ত, নকুলের সুঘোসা ও সহদেবের মণিপুষ্প। এছাড়া বিষ্ণুর হাতে ছিল শঙ্খ। সমুদ্র মন্থনকালে শঙ্খে বিষ নিয়ে পান করেছিলেন শিব। ভগীরথ শঙ্খ নিনাদের মাধ্যমে গঙ্গাকে মর্তে আনেন। সব মিলিয়ে তাই শঙ্খের প্রতি অন্যরকম ভক্তি হিন্দুদের। শঙ্খধ্বনিকে তারা মাঙ্গলিক বিবেচনা করেন। আর তাই প্রায় প্রতি ঘরেই শঙ্খ থাকে যতেœর সঙ্গে। দিনে অন্তত একবার এতে ফুঁ দিতে ভুল করেন না তারা। বিশেষ করে নতুন কোন কাজ শুরু করার ক্ষণে শঙ্খধ্বনি করা চাই-ই। আর পূজা-পার্বণে মূলত আনন্দবার্তা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে শঙ্খ। ড. আবদুল ওয়াহাব জানান, এর আগে যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হতো শঙ্খ। ঘোড়া, ঢাল-তলোয়ার তো ছিলই, সেই সঙ্গে বহন করা হতো শঙ্খ। ডামাডোলের মধ্যে যখন কারও কথা শোনার সুযোগ থাকত না তখন শঙ্খ বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হতো। রণে ভঙ্গ দেয়ার ঘোষণাও আসত শঙ্খ থেকে। পাশাপাশি একে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে এখন বদলে গেছে অনেককিছু। শঙ্খের অত ব্যবহার চোখে পড়ে না। বলা চলে, পূজার অনুষঙ্গ হয়ে এটি টিকে আছে। রাজধানী ঢাকার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারে প্রচুর শঙ্খ তৈরি হয়। পূজা উপলক্ষে উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। বিভিন্ন দোকান ঘুরে এমন ধারণা পাওয়া যায়। সংখ্যায় যেমন বেশি তেমনি রয়েছে নানা জাত। শামুকের শরীর দক্ষ হাতে বা মেশিন দ্বারা কেটে অদ্ভুত সুন্দর নক্সা করা হয়েছে। হাতে নিয়ে দেখলে সে সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পরা যায় না। বীজন নামের এক কারিগর জানান, শঙ্খের উৎস শামুক। সমুদ্র থেকে আসা এ শামুক আমূল বদলে দেন কারিগররা। যার যেমন রুচি, একে গড়ে নেন। নিপুণ হাতে আঁকা হয় ফুল, লতাপাতা। অনেকে আবার সোনা ও রুপার পাত দিয়ে অলঙ্কৃত করেন। সুব্রত নামের আরেক কারিগর জানান, নিজের মেধা ও কাজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী শঙ্খ তৈরি করেন তারা। এর আকার এবং কারুকাজের ওপর নির্ভর করে দরদাম। জানা যায়, সারাবছরই কম-বেশি বিক্রি হয়। তবে এখন শারদীয় দুর্গাপূজা। ফলে বিক্রি অনেক বেড়েছে। ম-পে আসা-যাওয়ার পথে পূজার্থীরা শঙ্খ কিনে তাতে ফুঁ দিতে দিতে বাড়ি ফিরছেন। তাদের অপার আনন্দের, মাঙ্গলিক ভাবনার সঙ্গী হয়েছে শঙ্খ।
×