ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জাব্বার

একুশ শতক ॥ শিশুরাই হোক প্রোগ্রামার

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ শিশুরাই হোক প্রোগ্রামার

॥ এক ॥ অবশেষে একটি মাইলফলক কাজের সূচনা আমরা করতে পেরেছি। গত ২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার সারাদিন আমরা ৩০ জন স্কুল শিক্ষককে এমআইটি ল্যাব উদ্ভাবিত শিশুদের প্রোগ্রামিং ভাষা স্ক্র্যাচ শেখানো শুরু করেছি। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ও ২২ সেপ্টেম্বর তৃতীয় ব্যাচ মিলে এই নিবন্ধ প্রকাশ করার সময় পর্যন্ত ১০০ শিক্ষক ও অন্য আগ্রহীদের দিনব্যাপী কর্মশালার মধ্য দিয়ে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ভাষা শিশুদের কেমন করে পড়ানো যায় তার আয়োজন করেছি। এ বছরই আমি আমাদের শিশুদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করব। এ বছরই হাজার হাজার শিশুকে আমরা প্রোগ্রামিং শেখাব। অনেক আগে থেকেই ভাবছিলাম শিশুদের থেকেই শুরু করতে হবে প্রোগ্রামিংয়ের জগত। কারও কারও সামনে প্রসঙ্গটি উপস্থাপনও করেছি। কিন্তু জবাবটা বরাবরই হাতাশাজনক হয়েছে। কেউ ভাবতেই পারেন না যে, প্রোগ্রামিংয়ের মতো জ্ঞানটি শৈশব থেকেই নেয়া যেতে পারে। ২০০৮ সালেও নিজের ঘরে বসে বিজয়কে দেখেছি শৈশবেই অতি চমৎকারভাবে স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করতে। আমার এই সন্তানকে দিয়েই আমি অনুভব করতে পেরেছি যে শৈশবের আগ্রহ থেকেই সে এখনকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়ে পারদর্শী হতে পেরেছে। যদি সেদিন তাকে প্রোগ্রামিং এর যুক্ত, সমস্যা সমাধানের চ্যালেঞ্জ ও সৃজনশীলতার দিকে আকৃষ্ট করা না যেত তবে আজকে আমার নিজের সন্তানটির দক্ষতা আমি গর্ব করে বলতে পারতাম না। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারক বা প-িতরা এটি মানতেই চান না। তারা এখনও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বা তার ওপরে প্রোগ্রামিং শেখানোর কথা ভাবেন। এতদিন তারা ইউনাউটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো করে বাস্তবকে স্বীকারও করতেন না। প্রথমেই আমি আপনাদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ভাষার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাদের আগ্রহ আছে তারা স্ক্র্যাচ বিষয়ে ইন্টারনেটে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। ওখানে বলা আছে, The Scratch project, initiated in 2003, has received generous support from the National Science Foundation (grants 0325828, 1002713, 1027848, 1019396), Intel Foundation, Microsoft, MacArthur Foundation, LEGO Foundation, Code-to-Learn Foundation, Google, Dell, Fastly, Inversoft, and MIT Media Lab research consortia. (https://scratch.mit.edu/about/) ২০০৩ সালে সূচনা হলেও স্ক্র্যাচ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় ২০০৭ সাল থেকে। আমি আগেই বলেছি যে আমার ছেলে বিজয়কে ২০০৮ থেকেই স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং শুরু করতে দেখেছি। এমনকি এরপর যখন সে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়েছে তখনও তার প্রিয় বিষয় ছিল স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করা। এই দশ বছরে বস্তুত এই প্রোগ্রামটি বিশ্বকে জয় করেছে। এমআইটি ল্যাব এর সাইটে বলা হয়েছে, With Scratch, you can program your own interactive stories, games, and animations, and share your creations with others in the online community. Scratch helps young people learn to think creatively, reason systematically, and work collaboratively, essential skills for life in the 21st century. Scratch is a project of the Lifelong Kindergarten Group at the MIT Media Lab. It is provided free of charge. ভেবেছিলাম দেশের শিশুদের মাঝে স্ক্র্যাচ ছড়িয়ে দেব। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। তবুও গত কয়েক বছর ধরে আমি চেষ্টা করছি শিশুদের সঙ্গে সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং বিষয়টিকে পরিচিত করাতে। প্রথমে নিজে এমআইটি ল্যাব উদ্ভাবিত স্ক্র্যাচ নামক এই প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজটি পরীক্ষা করে দেখি। ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সের শিশুর জন্য খুব সহজে প্রোগ্রামিং ধারণা পাবার জন্য এটি একটি অতি চমৎকার প্রোগ্রামিং ভাষা। এমআইটির মন্তব্য হচ্ছে, ঝপৎধঃপয রং ফবংরমহবফ বংঢ়বপরধষষু ভড়ৎ ধমবং ৮ ঃড় ১৬, নঁঃ রং ঁংবফ নু ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ধষষ ধমবং. গরষষরড়হং ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব ধৎব পৎবধঃরহম ঝপৎধঃপয ঢ়ৎড়লবপঃং রহ ধ রিফব াধৎরবঃু ড়ভ ংবঃঃরহমং, রহপষঁফরহম যড়সবং, ংপযড়ড়ষং, সঁংবঁসং, ষরনৎধৎরবং, ধহফ পড়সসঁহরঃু পবহঃবৎং. এই এক দশকে এই ভাষাটি দিয়ে লাখ লাখ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে যা শিশুদের সৃজনশীলতাকে বিশ্বজুড়ে উন্মোচিত করেছে। এরপর এর প্রশিক্ষণ সামগ্রী রচনার দিকে মনোযোগী হই। আমার কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক স্তরে পড়ুয়া ছেলে বিজয়কে প্রশিক্ষণ সামগ্রী প্রস্তুতের অনুরোধ করলে সে সাগ্রহে কাজটি শুরু করে এবং এখন এটি একটি কর্মশালায় উপস্থাপনের স্তরে রয়েছে। ১৫ সালের নবেম্বর মাসে এই বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক আরও একটি ঘটনা ঘটে। সরকারের আইসিটি বিভাগ শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখার কর্মসূচী হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তাদের ভাবনা-চিন্তা এখনও মাথায়ই রয়ে গেছেÑ কাগজেও নামেনি। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড জাতীয় বড় ঘটনার চাপে পড়ে শিশুদের কাজগুলো হারিয়েই গেছে। তবে আমি আশাবাদী যে কোন না কোন সময়ে সরকারের নজরে এই বিষয়টি পড়বেই। আমাকে অবাক করে দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম হলো, ‘শিশুরাই হোক প্রোগ্রামার।’ খবরটি এ রকম, ‘ব্ল্যাক বোর্ডে ইংরেজী হরফের ‘খটমট’ কিছু শব্দ ও সঙ্কেত। বীজগণিতের সঙ্গে মেলে, আবার কোথায় যেন অমিল। চট করে বুঝে ওঠা কঠিন। অথচ ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে বসা মুখগুলো দিব্যি এ নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষকের করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষকের আলোচনায় একের পর এক সমাধান। শিক্ষকের চোখে তৃপ্তির আভা। এমন কাঠখোট্টা বিষয়ও যেন আনন্দ নিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বলছিলাম আউটসবুক প্রোগ্রামিং পাঠশালার কথা। আর ‘খটমট’ শব্দ ও সঙ্কেত প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা। আউটসবুক তরুণদের একটি সংগঠন। যাঁরা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী করতে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের স্বপ্ন, একদিন স্কুল শিক্ষার্থীরাই বানাবে নতুন নতুন সফটওয়্যার ও গেম। এর অংশ হিসেবে প্রোগ্রামিং পাঠশালা শুরু, যেখানে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিংয়ের সবকিছু পড়ানো হয়।’ না ওরা ঠিক শিশু নয়, আমি যাদের কথা ভাবছি। তবে ওদেরও শৈশব আছে এবং বাংলাদেশের সংজ্ঞা অনুসারে তারা ১৮ বছর পার না করায় শিশুই রয়েছে। কোন সন্দেহ নেই এটি একটি শুভ সূচনা। কিন্তু আমার ভাবনাটি একেবারেই ৮-১৬ বছরের শিশুদের প্রোগ্রামার বানানোর। একই সঙ্গে আমি বড়দের প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে শিশুদের ভারাক্রান্ত করতে চাই না। যদিও এই স্কুলটি শিশুদের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা নয় এবং বস্তুত স্কুল-কলেজের পাঠ্য বিষয় হিসেবে প্রোগ্রামিং শেখার যে চাপটা আছে তার চাহিদা মেটায় তবুও এমন উদ্যোগ প্রশংসা করার মতো। দেশের অনেক স্থানেই বাধ্যতামূলক আইসিটি শিক্ষাকে ঘিরে এ ধরনের স্কুল বা কোচিং সেন্টার গড়ে ওঠেছে এবং এটি হয়ত এক সময়ে বেশ লাভজনক ব্যবসায়েও পরিণত হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন শিশুদের প্রোগ্রামার বানাতে হবে। আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর শেখ হাসিনার সরকার তথ্যপ্রযুক্তিতে যে নতুন জোয়ার আনেন তার অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল দেশে প্রোগ্রামারের সংখ্যা বাড়ানো। শেখ হাসিনা নিজে এক সময়ে বছরে দশ হাজার প্রোগ্রামার বানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ২০০১ সালের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার সেই স্বপ্নকে আঁতুড় ঘরেই মেরে ফেলেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর দেশে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু একটি বড় ধরনের গলদ এখনও দৃশ্যমান। আমি বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের মহাসচিব জনাব মুনির হাসানের উদ্ধৃতি থেকে এই বিষয়টি জানাতে পারি যে আমাদের দেশে যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে তাদের মাঝে প্রোগ্রামার হবার প্রবণতা নেই বললেই চলে। জানা মতে, শতকরা মাত্র ৭ জন কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট ছেলে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হয়। মেয়েদের অবস্থা আরও নাজুক। শতকরা মাত্র একজন মেয়ে প্রোগ্রামার হতে চায়। এই ভয়ঙ্কর অবস্থার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, প্রোগ্রামিং শেখাটিকে ওই বয়সে কঠিনতম মনে হয়। আমরা আরও লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই দুর্বলতার জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে ছেলে মেয়েরা চাকরি খুঁজে পায় না। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতকরা প্রোগ্রামিংয়ের বদলে অন্য দক্ষতাকে প্রাধান্য দেয়। ১৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে যা জানতে পারি তা ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা জানালেন যে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের ড্রপ আউটের হার শতকরা ৫৮ ভাগ। এই ড্রপ আউটটাও হয় মাত্র দুই সেমিস্টারের মাঝে। এসব ছাত্র-ছাত্রীরা ১-২ সেমিস্টার শেষ করেই বিবিএ বা এমন অন্য কোন বিষয়ে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। যারা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে থেকে যায় তারাও যেভাবেই হোক প্রোগ্রামিং থেকে দূরে সরতে চায়। আজকের দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বা সামনের দুনিয়াটিকে কল্পনা করতে গিয়ে আমরা ভয়ঙ্করভাবে শঙ্কিত না হয়ে পারি না যেÑ আমরা যোগ্যতাহীন মানবসম্পদ তৈরি করছি। দুনিয়ার তাবত মানুষ এটি অনুভব করে যে আগামী দিনের প্রযুক্তিতে বিদ্যমান কম্পিউটার জ্ঞানও কাজে লাগবে না। অথচ আমরা আমাদের পরের প্রজন্মকে সেই যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহিতও করতে পারি না। ঢাকা ॥ ২২ সেপ্টেম্বর, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×