ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চরবাসীর বিপদের বন্ধু তালেব ও রাবেয়া

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চরবাসীর বিপদের বন্ধু তালেব ও রাবেয়া

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ‘অর্ধশতাধিক চরজনপদের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসা তারা দু’জন। চরের মানুষের বিপদের বন্ধুও বলা হয় তাদেরকে। তাদের একজন ‘তালেব ভাই’ অপরজন ‘রাবেয়া আপা’ নামে চরের মানুষের পরিচিত আপনজন। ‘রাবেয়া আপা’ ৫০ বছর ধরে আর ‘তালেব ভাই’ ২২ বছর ধরে চরের মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। চরে কারও জ্বর, ডায়রিয়া বা কোনও অসুখ হলে ‘তালেব ভাই’ আর প্রসবকালীন সমস্যা হলেই ডাক পড়ে ‘রাবেয়া আপা’র। মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা দু’জন নীরবে মানবসেবা করে যাচ্ছেন। কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার পশ্চিমে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ এর মাঝে নানা চর-দ্বীপচর। নদ-নদী বিচ্ছিন্ন চরের মানুষ বরাবরই সরকারী চিকিৎসা সেবাসহ প্রায় সব ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় চরের মানুষ অবহেলিত। সামান্য জ্বরের ওষুধ কিনতে তাদের অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়। বালুচর ভেঙ্গে, খেয়া পারাপার এবং পায়ে হেঁটে কয়েক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে যেতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কোন ওষুধের দোকানে। চরের মানুষের যোগাযোগ মানেই হেঁটে আর খেয়ার নৌকা। প্রায় সময় রোগীকে শহরের হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ওই ‘তালেব ভাই’ আর ‘রাবেয়া আপা’ই রোগীকে বিপদের সময় চিকিৎসা দেয়। বলতে গেলে চরের মানুষের চিকিৎসা সেবায় একমাত্র ভরসা তারা দু’জন। তালেব ভাই : রৌমারী উপজেলার উত্তর ফুলুয়ার চর গ্রামের আমজাদ হোসেনের পুত্র আবু তালেব (৪৭)। তীব্র অভাবের কারণে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন। এরপর পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি চিকিৎসা সেবা শুরু করেন ১৯৯৩ সালের দিকে। চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধও বিক্রি করেন। এখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তার সংসার। সম্প্রতি পালের চরে চিকিৎসা সেবা দেয়া অবস্থায় কথা হয় আবু তালেবের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে ওষুধের ব্যাগ রেখে চিকিৎসাপত্র দিচ্ছেন একজন নারীকে। তিনি জানান, সাইকেলে চরে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে চর ও দ্বীপচরের মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। একেক দিন একেকটা চরে যান তিনি। এক চরে গেলে প্রায় সারাদিনই চলে যায়। যাতায়াতের সময়ও চিকিৎসা প্রদান করেন। এভাবেই গত ২২ বছর থেকে চরের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি রোগীকে ওষুধপত্রও দেন তিনি। এ থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই তার সংসারের সব খরচ চলে। আবু তালেব বলেন, ‘মানুষের বিপদে আপদে মানুষ এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটা আমার পেশা হলেও এর মধ্যে সেবাও রয়েছে। ধরেন, চরের কোন রোগী আমাকে ফোন করল। আমি খেয়া পারাপার হয়ে চরের ওই রোগীর বাড়িতে গেলাম। তারা মাত্র ১০ টাকার ওষুধ নিল, অথচ যাতায়াতেই আমার ১০ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। তাতেও আমার দুঃখ নেই। কারণ চরের ওই মানুষগুলো সময় মতো ওষুধ ও মনে সাহস তো পেল। এখানেই আমার শান্তি। আল্লাহ যতদিন বাঁচিয়ে রাখে ততদিন চরের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। চরের মানুষের সেবা করার মধ্য দিয়েই যেন আমার মৃত্যু হয়।’ রাবেয়া আপা : রাজীবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরি নদী দ্বারা বেষ্টিত সাজাই কারিগর পাড়া গ্রামের রাবেয়া বেগম। জমাজমি বলতে বাড়ির ভিটাটুকু। ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে ১০ বার বাড়ি ভেঙ্গে গেছে। তারা এখন নিঃস্ব। রাবেয়া বেগমের বয়স প্রায় ৭২। এই বয়সেও মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে চলেন এ চর থেকে ও চরে। চরাঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত একটা নাম ‘রাবেয়া আপা’। মাদের প্রসবকালীন সমস্যার সহায়ক হিসেবে রাবেয়া বেগমের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। যে ভাবে শুরু : রাবেয়া বেগমের দাদি মিনারা বেগমও ছিলেন একজন দক্ষ দাই। রাবেয়ার বয়স যখন ১৫ তখন তার দাদির সঙ্গে প্রসবকালীন গর্ভবতীদের প্রসবকালীন সময়ে দাদির কার্যক্রম খুব কাছ থেকে দেখেছেন। দাদির কাছ থেকে শিখেছেন নিয়মকানুন। মুক্তিযুদ্ধের বছর দুয়েক পর থেকেই গর্ভবতী ও প্রসূতি মাদের সেবায় এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন। এরপর বেসরকারী সংস্থা আরডিআরএসের উদ্যোগে একাধিকবার ধাত্রী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে সফলভাবে পাস করার পর সংস্থার পক্ষ থেকে একটি ফাস্ট এইড বক্স প্রদান করা হয় তাকে। এর মধ্যে জীবাণুরোধক ব্লেড, কাঁচি ও হ্যান্ড গ্লোব। প্রসবের পরিমাণ : রাবেয়া বেগম এক এক করে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার গর্ভবতীর সফল প্রসব করিয়েছেন। ৫৭ বছরে ওই পরিমাণ প্রসবকালীন কাছে মাত্র ১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রাবেয়া বেগম জানান, সংসারে অসুস্থ স্বামী আর হাজারো ঝামেলার মধ্যেও মানুষের বিপদে ছুটে গিয়েছি। প্রসবকালীন মা ও নবজাতককে রক্ষা করেছি মৃত্যুর দুয়ার থেকে। আমার কাছে টাকা পয়সা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। মানুষ হয়ে যদি মানুষের সহযোগিতা করা না যায় তাহলে মানুষ হলাম কেমনে। ঝড় তুফান, বৃষ্টি আর প্রচ- ঠা-া যে সময়ই হোক, কেউ ডাক দিলে আমি বসে থাকতে পারি না। কাজ শেষ হওয়ার পর তারা যে টাকা পয়সা দেয় তাই খুশি মনে গ্রহণ করি। কেউ টাকা দিতে না পারলেও মন খারাপ হয় না আমার। চরের মানুষ যা বলেন : চিলমারী উপজেলার করইবইশাল দ্বীপ চরের দিনমজুর বাহাদুর আলী বলেন, ‘১০ বছর আগের কথা। তার প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় চরের মানুষের পরামর্শে রাবেয়া বেগমকে নিয়ে আসি। অন্ধকার রাতে একটি নৌকা নিয়ে হাজির হলাম তার বাড়িতে। তার সাহচার্যে এবং নিবির পরিচর্যায় আমার বাচ্চা প্রসব হয়েছে। কোন বিপদ হয়নি। অসংখ্য বিপদের ঘটনায় রাবেয়া বেগম সহযোগিতা করছে বলে জানান ওই গ্রামের মোতালেব মেম্বার। তিনি বলেন, ‘রাবেয়া আপাই আমাদের চরের মানুষের একমাত্র ভরসা। যখন ডাকা যায় তখনই তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে আসেন।’ রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে
×