ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অভাবমুক্ত সংসার, ক্ষুধামুক্ত জীবন ॥ পাল্টে দিয়েছে মাছ-মুরগি সবজি চাষ

সমৃদ্ধির গ্রাম শিবপুর

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সমৃদ্ধির গ্রাম শিবপুর

ক্ষুধামুক্ত জীবন, অভাবমুক্ত সংসার ও সমৃদ্ধির একটি গ্রামের নাম শিবপুর। প্রতিদিন রাত পোহালেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় গ্রামের নারী-পুরুষদের। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই অভাবকে বিদায় জানিয়ে এখন ওই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার পুরোপুরি স্বাবলম্ভী হয়েছেন। আর এ সাফল্যের পেছনে গ্রামের গৃহবধূদের শ্রমকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন পুরুষ সদস্যরা। সূত্রমতে, গৃহবধূরা সংসার সামলিয়ে নিজেদের গড়ে তোলা মুরগি ও মাছের খামার এবং সবজি ক্ষেতের পরিচর্যা করে দিন কাটিয়ে থাকেন। এসব খামার ও আগাম সবজি বিক্রি করেই স্বাবলম্বী হয়েছেন শিবপুর গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার। একসময়ের দারিদ্র্য অঞ্চল বলে খ্যাত ওই গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা আজ নামী-দামী বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছেন। বরিশালের বিলাঞ্চল বলে খ্যাত উজিরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে সাততলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা শিবপুর গ্রাম। কয়েক বছর পূর্বেও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও দারিদ্র্য পীড়িত ওই গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো নৌকাযোগে বিলে মাছ ধরে ও শাপলা বিক্রি করে। যে কারণে অভাব অনটন ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বিদ্যুত ব্যবস্থা, তা ছিল স্বপ্নের রাজ্যে। মহাজোট সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পীকার এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুসের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রধান সড়ক সংস্কার ও কার্পেটিংয়ের পাশাপাশি প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলে রাস্তা নির্মাণ এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুত সংযোগ পৌঁছানোর ফলেই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে পুরো গ্রামবাসীর। প্রায় দুই হাজার ভোটারের শিবপুর গ্রামে হাতেগোনা মুসলমান ধর্মের লোকজনের পাশাপাশি সিংহভাগই (প্রায় চার শতাধিক) হিন্দু পরিবারের বসবাস। ওই গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি যোগেন সরকার (৮১) বলেন, বছরের বারো মাসের মধ্যে ৮/৯ মাস বিল পানিতে ডুবে থাকে। তাদের গ্রামে পুরো বছর জুড়েই যোগাযোগের জন্য নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। আগে নৌকাযোগে বিলে মাছ ধরে ও শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করাই ছিল তাদের গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র পেশা। বর্তমান সরকারের আমলে বিলের মধ্যে রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় গ্রামের নারী-পুরুষরা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই মৎস্য চাষের জন্য মাছের ঘের নির্মাণ করে তার মধ্যে মুরগি পালনের জন্য খামার (ফার্ম) নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘেরের চারপাশে আগাম সবজি চাষ করা হচ্ছে। একই জমিতে ঘের করে একসঙ্গে মাছ ও মুরগি পালনের সঙ্গে কৃষিকাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের প্রায় দুশতাধিক পরিবার। ওইসব পরিবারের নারীরা আয়ের পাশাপাশি এখন পুষ্টির জোগান দিচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন দারিদ্র্যতা কমছে, ঠিক তেমনিভাবে নারীরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। একসময়ের দারিদ্র্য অঞ্চলের প্রতিটি ঘরের ছেলেমেয়েরা এখন বিভিন্ন নামকরা স্কুল, কলেজে পড়াশোনা করছেন। ওই গ্রামের নির্মল রায় জানান, গত তিন বছর থেকে তিনি আড়াই বিঘা জমিতে মাছের ঘের নির্মাণ করে তারমধ্যে বিভিন্ন প্রজাতের মাছের চাষ করছেন। ঘেরের মাঝখানে নির্মাণ করেছেন বিশাল মুরগির ফার্ম। তার ফার্মে এখন প্রায় দুই হাজার মুরগি রয়েছে। একইসঙ্গে ঘেরের চারিপাশে তিনি আগাম সবজি চাষ করেছেন। তার সবজি ক্ষেতে এখন আগাম সিম, বরবটি, লাউ, করল্লা ও কুশি রয়েছে। সবজি ক্ষেতে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে ইতোমধ্যে তিনি প্রায় দুই লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। এ কাজের পাশাপাশি নির্মল স্থানীয় বিশারকান্দি বাজারে মুদি-মনোহরীর ব্যবসা করছেন। নির্মলের অনুপস্থিতিতে সবকিছু দেখভাল করেন তার স্ত্রী। নির্মল বলেন, কয়েক বছর আগেও অভাবের সংসারে আমাদের খেয়ে না খেয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। বর্তমানে অভাব নামের শব্দটি আমাদের জীবনে নেই। ওই গ্রামের দিনমজুর শিবা বিশ্বাস জানান, একসময় বিলে মাছ ধরে ও শাপলা বিক্রি করে সামান্য আয়ে তার সংসার চলছিল না। বর্তমান সরকারের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় গত তিনবছর পূর্বে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তিনি নিজস্ব এক বিঘা জমিতে ঘের নির্মাণ করে মাছ চাষ শুরু করেছেন। একইসঙ্গে ঘেরের চারপাশে আগাম সবজি চাষ করা হয়। একবছরের সবজি বিক্রির টাকায় তিনি পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করেছেন। পরবর্তী বছরের উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি গত দু’বছর পূর্বে ঘেরের মধ্যে মুরগির ফার্ম করেছেন। শিবা বিশ্বাসের মতে, মাছ, মাংস ও সবজি সবই উৎপাদিত হচ্ছে তার ঘেরে। যা বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটানো হচ্ছে। তার সন্তানরা আজ স্কুলে পড়াশোনা করছে। আগে দু’বেলা আধপেটা খেয়ে তাদের জীবন চললেও এখন সেসব অতীত। সাতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক আজাদ জানান, তিনি নিজেও সমিতির মাধ্যমে গ্রামের শতাধিক পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকারের আমলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও ঘরে ঘরে বিদ্যুত সংযোগ পৌঁছে দেয়ায় শিবপুর গ্রামের দু’শতাধিক পরিবার একসঙ্গে তিনটি (মাছ, মুরগি ও সবজি) চাষ করার মাধ্যমে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। আর এ সাফল্যের জন্য প্রতিটি পরিবারের নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। খোকন আহম্মেদ হীরা বরিশাল থেকে
×