ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনে বিপন্ন মানবতা লাশের ওপর দিয়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে অসংখ্য রোহিঙ্গা ষ বীভৎসতা দেখা শিশুরা কথা বলছে না

বাড়ির আঙ্গিনা নদী পুকুর জঙ্গলের সবুজ পাতা রক্তে লাল

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাড়ির আঙ্গিনা নদী পুকুর জঙ্গলের সবুজ পাতা রক্তে লাল

স্টাফ রিপোর্টার. টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে ॥ টেকনাফের শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠসহ আশপাশের সবকটি পাহাড়ে এখন ছোট ছোট ঝুপড়িঘর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে চিরচেনা বেদে সম্প্রদায়ের অস্থায়ী আবাস। কাছে গেলে দৃশ্যপট ভিন্ন। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আশপাশের অবস্থা ঠিক এরকম, কেউ কেউ রাস্তায় বসে আছেন। কেউবা সড়কের পাশে বা কারও বাড়ির আঙ্গিনায় আশ্রয়ের অপেক্ষায়। বৃষ্টি আর কাদাপানিতে সন্তান কোলে নিয়ে জঙ্গলেও বসে আছেন কেউ। খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে মায়ের কোলে থাকা শিশুরা। গাড়ি দেখলেই ত্রাণের আশায় ভিড় জমাচ্ছেন। কেউ কেউ সরাসরি হাত পাতছেন। টাকাও চেনেন না বেশিরভাগ মানুষ। বাংলাদেশের কাউকে পেলে নোট দেখিয়ে জানতে চান কত টাকা। ভাষাগত জটিলতায় অনেকেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে টাকার পরিমাণ দেখান। বেশি টাকা হলে শত কষ্টের মধ্যেও মাঝে মাঝে মুচকি হাসার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। টেকনাফ সদর থেকে উখিয়া বাজার পর্যন্ত দৃশ্য ঠিক এ রকম, যেখানে শুধু বিপন্ন মানবতার দৃশ্য চোখে পড়ে। নির্যাতিতরা কাউকে পেলেই ঘটনার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেন। কষ্টের কথা বলে হয়ত নিজেকে একটু হাল্কা করতে চান। আশ্রয়, সহায়তা আর খাদ্যের আশায় অসহায় মানুষের নিরন্তর অপেক্ষা। এখানে যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই স্বজনহারা মানুষ। কেউ কেউ নিজেই নির্যাতনের শিকার। কারও হাত-পা, মাথা কিংবা শরীরের যে কোন অংশে আঘাতের চিহ্ন। মারাত্মক আহত শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলতে দেখা গেছে অনেক মাকে। তাদের কেউ সন্তানহারা। কোল থেকে আদরের সন্তান কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, এমন মাও আছেন এখানে। চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছে বাবা-স্বামী, প্রিয়জন কিংবা প্রতিবেশীকে, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। কেউ বন্দুকের নল থেকে কোন রকম প্রাণভিক্ষা চেয়ে বেঁচে এসেছেন। তাদের প্রত্যেকের বুকে চাপা কষ্ট। দগদগে ক্ষত। যন্ত্রণা। যারা নির্যাতনের শিকার কিংবা নারকীয় তা-ব দেখে এসেছেন তাদের কারও চোখে ঘুম নেই। সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভয়ে অনেক শিশু এখন আর কথা বলে না। স্বজন হারানোর বেদনায় চোখ-মুখ ফোলা। কষ্ট, সংগ্রাম আর যন্ত্রণায় এখন চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। অনাহারে মায়ের বুকের দুধও পাচ্ছে না অনেক শিশু। বলছি মিয়ানমার থেকে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কথা। ‘গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়’ শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই ছোট্ট পাহাড়, যেখানে ১৫ দিন আগেও ছিল ঘন বন। এখন তা আর চেনার কোন উপায় নেই। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। বসতি বলতে ছোট্ট একটি জমি সমতল করা হয়েছে। বাঁশ আর পলিথিন দিয়ে কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই। এখানে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের একজন দিলদার বেগম (৪০)। বাড়ি মিয়ানমারের মংডু এলাকার আন্ডায়। চোখ-মুখ ফোলা। গলা দিয়ে স্বরও বেরোচ্ছিল না। নয় দিন আগেও নিজ বাড়িতেই ছিলেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। সময় সকাল ১০টা। হঠাৎ পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনীর লোকজন। সঙ্গে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও অনেকে আসে। আমরা ভীতসন্ত্রস্ত। কী করব উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো দ্রুত বাড়ি থেকে পালিয়ে দেশ ছাড়তে। নইলে সবাইকে হত্যা করা হবে। এ কথা বলতে বলতেই বৃষ্টির মতো গুলি আসতে লাগল। আমরা ভয়ে জঙ্গলে গিয়ে পালালাম। শুয়ে থাকলাম মাটিতে। দেখলাম গুলিতে আহত অনেকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অনেকের দেহ নিথর হয়ে গেছে। রক্তে ভিজে গেছে উঠান। মিশেছে পুকুর আর নদীর জলে। জঙ্গলের সবুজ পাতাও লাল হয়ে যায় রক্তে। এমন দৃশ্য কোনদিন দেখিনি। দিলদার বেগম আরও জানান, আমাদের চার ছেলেমেয়ে। দুটি শিশুকে জঙ্গলের মাটিতে রেখে ওদের বুকের ওপর আলতো করে আমি শুয়েছিলাম। অন্য দুই সন্তানের বুকে শুয়েছিল ওদের বাবা। বীভৎসতা দেখে শিশুরা কাঁদছিল। ওদের অনেক কষ্টে বোঝাতে হয়েছে, ‘তোমরা কাঁদলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।’ বিকেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কমপক্ষে এক হাজার মানুষ পুরো গ্রাম ঘিরে রেখেছিল। একপর্যায়ে মাইকে বলা হলো, গুলি চালানো হবে না। বাঁচতে চাইলে হাত তুলে বেরিয়ে এসো। নদী-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশ ছাড়। আমরা হাত তুলে বেরিয়ে এলাম। পথে পথে দেখে এলাম লাশ। জ্বলছে পুরো গ্রাম। গ্রামের পর গ্রাম। যেন রক্তাক্ত জনপদ। যুবক-যুবতী-নারী-শিশুর করুণ আর্তনাদ। অনেকে প্রিয়জনের লাশ রেখে জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছেন। দাফন-কাফন করাও সম্ভব হয়নি। এরপর থেকে দিলদার বেগমের চার বছরের ছোট্ট কন্যাশিশু ‘নূর কায়েদা’ আর কথা বলে না। শত চেষ্টা করেও তাকে আর কথা বলানো যাচ্ছে না। অথচ দিনভর চঞ্চলতায় বাড়ি মাতিয়ে রাখত এ শিশুটি। নিজ চোখে সেনাবাহিনীর তা-ব দেখেছে সে। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কেঁদে জড়িয়ে ধরে। অন্য সন্তান সালাম, দিন-ই সালাম, আনোয়ার সাদেকও চুপচাপ। দিলদার বেগমের স্বামী জায়েদ হোসেন জানান, প্রতিবেশী মাস্টার এরফান, রহমত উল্যাহ, মালেকের লাশের ওপর দিয়ে বলতে গেলে আমরা আসি। তাদের রক্তাক্ত দেহ চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে। তবুও জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে হয়েছে। সন্তানদের বাঁচাতেই আমরা বাংলাদেশে আসি। নয়ত আসতাম না। যা হওয়ার হতো। তিনি বলেন, সমুদ্রের কাছে আসার পর জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে এপারে আসতে দালালদের দিতে হয়েছে। কিছুই করার ছিল না আমাদের। যারা টাকা দিতে পারেনি তাদের আনা হয়নি। তোলা হয়নি নৌকায়। আমার চার শিশুর জন্য ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তিনি জানান, জায়গা-জমি সবই গেছে আমার। জানি না আর ফিরতে পারব কি-না। অথচ শান্তির জন্য আমরা সুচিকে ভোট দিয়েছিলাম। তিনি তো আমাদের রক্ষা করলেন না। তাহলে কার কাছে বিচার চাইব- এমন প্রশ্ন রাখেন জায়েদ। পথে পথে বিপন্ন মানবতা টেকনাফের শেষ সীমানা মেরিনড্রাইভ থেকে শামলাপুর বাজার, রামু, হিমছড়ি, থায়ংখালী বাজার, বালুখালী পাহাড়, বালুখালী ছড়া, বালুখালী বাজার থেকে উখিয়া বাজার পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ঢল। পাহাড়, জঙ্গল, রাস্তা, বাড়ির আঙ্গিনা, জমি সবখানেই রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। টেকনাফ-উখিয়া সড়কের দু’পাশে শরণার্থীর ঢল। কোন ফাঁকা জায়গা নেই। কোন কোন এলাকায় রাস্তার পাশে কাপড় বিছিয়ে তাদের বসে থাকতে দেখা যায়। কোথাও বৃষ্টি হওয়ায় কেউ কেউ নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সড়কের দু’পাশে পড়ে আছে ছোট ছোট অসংখ্য কাপড়ের টুকরা। একটি গাড়ি আসতেই রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা দৌড়ে ছুটে যায়। হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু পাওয়ার আশায়। বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন অনেকে। কেউ বিস্কুট দেন, কেউবা টাকা দেন। আবার ট্রাকে যেখানে ত্রাণ দিতে দেখা গেছে সেখানে হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ লাইন। সবাই ত্রাণ পাবেন কি-না নিজেরাও জানেন না। বালুখালী ছাড়ার মাঠের আশপাশে বিশাল বিশাল পাহাড়। কুতুপালংয়ে পাহাড়ের কোন অভাব নেই। বিশাল বিশাল উঁচু পাহাড়ে এখন সবুজ বন দেখা যায় না। অর্থাৎ বন কেটে উজাড় করে দেয়া হয়েছে। চোখে পড়ে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কালো পলিথিনের ছোট ঝুপড়িঘর। সেখানেই গাদাগাদি করে বসবাস। এখনও হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে, যাদের ঘর তোলা বা আসবাসপত্র কেনার কোন সামর্থ্য নেই। অর্থের অভাবে দুই সন্তান নিয়ে বালুখালী ছড়ার মাঠের পাশে রাস্তার পানিতে দাঁড়িয়েছিলেন রোহিঙ্গা নারী সুজানা। কোলে ছয় মাসের ছেলেসন্তান। পানি আর খাদ্যের অভাবে শিশুটির স্বাভাবিক আচরণ বন্ধ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে রায়হান। গত দুই দিন হলো মায়ের কোল থেকে আর ঘাড় ওঠে না। হাসেও না। কিন্তু অর্থ-সম্পদ, স্বামী কোনকিছুই নেই এ অসহায় নারীর। স্বামী কোথায় আছেন তিনি জানেন না। বেঁচে আছেন কী নেই, এমন খবরও তার কাছে নেই। টাকা নেই। তাই নৌকায় পর্যাপ্ত জায়গা পাননি তিনি। মানবিক কারণে তাকে নৌকায় আনা হয়। মানুষের ভিড়ে ঠাসা। নৌকায় জায়গা নেই। তাই এক ছেলেকে কাঁধে নিয়ে আরেক ছেলেকে কোলে করে জলপথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন তিনি। প্রতিদিনই কিছু পথ হাঁটেন। খাবারের সন্ধানে হাঁটতে হাঁটতে এসেছেন বালুখালী পর্যন্ত। সুজানা জানান, খাবার নেই তাই বুকে দুধও নেই। শিশুটি এখন কী খাবে? দুধ না পেয়ে ও এখন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। জানালেন, রাস্তার পাশে জঙ্গলে রাতে ঘুমান। এ অনিশ্চিত জীবনের শেষ কোথায় নিজেও জানেন না। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব। স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে কিছু ভ্রাম্যমাণ টয়লেটের ব্যবস্থা করা হলেও তা অপ্রতুল। কুতুপালং বাজারে গাড়ি থামতেই হাত পাতেন মিয়ানমারের তুলাতুলি অঞ্চলের বাসিন্দা আমির হোসেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১২ জন। তাদের মধ্যে ১০ জনই শিশু। পানির দামে জমি বিক্রি করে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া করে সবাইকে নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। গত কয়েকদিনে জমানো টাকা শেষ। তাই যাকেই পাচ্ছেন তার কাছেই হাত পাতছেন তিনি। বলছেন, ১০ জনের মধ্যে তিনটি শিশু মায়ের দুধ খায়। শিশুদের বাঁচাতে মায়ের জন্য হলেও খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। অন্যথায় ছোট্ট শিশুগুলোকে আর বাঁচানো যাবে না। সকালে সংগ্রহ করা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়েছে অন্য শিশুদের। কথা হলো মেরুলা কুসুমদারা, হাসিনা, সাহেদাসহ আরও বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে। তারা প্রত্যেকেই জানালেন খাদ্য সঙ্কটে শিশুরা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে সে আশঙ্কার কথা।
×