ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদার সফরও অনিশ্চিত

ভারতের সঙ্গে কিছুতেই সম্পর্ক উন্নত করতে পারছে না বিএনপি

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ভারতের সঙ্গে কিছুতেই সম্পর্ক উন্নত করতে পারছে না বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ প্রাণপণ চেষ্টা করেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারছে না বিএনপি। আর এ কারণে খালেদা জিয়ার ভারত সফরও এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। তবে বিএনপি চায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। সে লক্ষ্যে ভেতরে ভেতরে চেষ্টাও চলছে। সূত্র মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে গিয়ে বিভিন্ন মহলের সহযোগিতা নেন। ছেলে তারেক রহমান ও লন্ডন বিএনপির নেতাদের সহযোগিতায় ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন একটি প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে দেনদরবার করেন। কিন্তু কিছুতেই ভারতের সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক করার আশ্বাস পাচ্ছেন না। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের আশ্বাস পাচ্ছেন না। ১৫ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডনের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এ সময় বিএনপির পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল লন্ডন সফরে থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া ভারতের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারবেন এবং দেশে ফিরে নবেম্বরের দিকে ভারত সফরে যাবেন। আর এ সফরের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে ভারতের সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সহযোগিতা চাইবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে থেকে ২ মাসের বেশি সময়ের মধ্যেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে কোন সুখবর বয়ে আনতে পারেননি। জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সহযোগিতার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার জন্য এখনও লন্ডন থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এ কারণেই তার দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে খালেদা জিয়ার চোখের চিকিৎসার কারণেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে দেরি হচ্ছে। বিএনপি সূত্র জানায়, লন্ডন থেকে দেশে ফিরে সুবিধাজনক সময়ে খালেদা জিয়া ভারত সফরে যেতে চান। তবে এ বিষয়ে এখনও কোন দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। দলের কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু নেতা এ বিষয়টি দেখছেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশ্বের অনেক দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও শুধু ভারতের সহযোগিতা পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকার নির্বাচনটি করে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়। আর রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে বিএনপিকে ভারতের সহযোগিতা পেতে হবে। আর এ কারণেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১২ সালে (২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নবেম্বর) খালেদা জিয়া ভারত সফরে গেলে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয় ভারতের কংগ্রেস সরকার। সে সফরে গিয়ে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া তিনি সে দেশের বিরোধী দলের সঙ্গেও বৈঠক করেন। এর ফলে এক সময় বিএনপি ভারত বিরোধী বক্তব্য নিয়ে সোচ্চার থাকলেও খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর ভারত বিরোধিতার পরিবর্তে সে দেশের পক্ষে বক্তব্য রাখতে থাকেন খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তবে খালেদা জিয়ার ভারত সফরকালে ভারতের পক্ষ থেকে তাকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করাসহ কিছু পরামর্শ দেয়া হয়। এ খবর শুনে জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। তাই রাজনৈতিক জোট রক্ষার স্বার্থে বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই একের পর এক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে থাকে। তবে এ বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেনি ভারত। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে সাক্ষাত করার কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। সেদিন ছিল ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের হরতাল। হরতালের মধ্যে গাড়ি বহর নিয়ে গুলশানের বাসা থেকে সোনারগাঁও হোটেলে গেলে হরতাল ভঙ্গ করা হবে এবং এ জন্য দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত নাখোশ হবে মনে করে সেদিন খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে না গিয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ করেন। তবে খালেদা জিয়ার এ অবস্থানে খোদ বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা নাখোশ হলেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা খুশি হন। তবে প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত অনুষ্ঠানে না গিয়ে খালেদা জিয়া যে অসৌজন্যতা দেখিয়েছেন তা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এ নিয়ে সোচ্চার হয়। ২০১৩ সালের শেষদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ এগিয়ে এলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত এ ব্যাপারে কোন সাড়া দেয়নি। বরং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তখন বরাবরই বলা হয় বাংলাদেশ সরকার সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করলে এতে তাদের কোন আপত্তি নেই। প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারতের এ অবস্থানের কারণে বিএনপির কূটনৈতিক মিশন ব্যর্থ হয়। এর ফলে বিএনপি জোটের লাগাতার আন্দোলনসহ নির্বাচন বয়কটের হুমকি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে ফেলে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও বিএনপি বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের সমর্থনের পাশাপাশি ভারতের সমর্থন আদায় করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কৌশল নেয়। বিশেষ করে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপি সেদেশের সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে সবার আগে নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অপরদিকে লন্ডন থেকে তারেক রহমানও নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির প্রভাবশালী নেতাদের অভিনন্দন জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির যে শপথ অনুষ্ঠান হয় সে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। জানা যায়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে খালেদা জিয়া পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত কর্মসূচীতে না যাওয়ায় ভারত বিএনপির প্রতি চরম নাখোশ হয়। কারণ প্রণব মুখার্জী শুধু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবেই নন, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে ভারতবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তাই কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রণব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেও তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যথার্থ সম্মান শ্রদ্ধার জায়গায় রেখেছেন। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে প্রণব মুখার্জীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দেশাত্মবোধ ও সৌজন্যবোধের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন নরেন্দ্র মোদি। তাই প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার অসৌজন্যমূলক আচরণের পর বিএনপিকে এখনও মাসুল দিতে হচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে না পারার অনেক কারণ রয়েছে। কারণ, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলের নেতাকর্মীরা ভারত বিরোধী প্রচারণা শুরু করে। তারা বরাবরই বলে আসছেন স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের গোলামি চুক্তি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নাকি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে চালানো হয়েছে নানা উৎকট প্রচার। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে ভারত বিরোধী প্রচার মাঠে ছড়ানো হয়।
×