ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) ভ্যানকুভার থেকে আকাশপথে ক্যালগেরির দূরত্ব এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিটের মতো। আর বাসে পনেরো ঘণ্টারও অধিক। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার পক্ষ থেকে, বাংলাদেশে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির সুবাদে পরিচিত বন্ধু শৈলন দাশ যে স্থায়ী নিবাস গড়েছে ক্যালগেরিতে তার ওখানে উঠব কিন্তু মহারানীর আদরের ছোট ভাই প্রকৌশলী রানাদের আবদার না মেটানোর সাধ্য আমাদের ছিল না। অগত্যা হার মানতেই হলো রানার ছোট্ট সংসারে অতিথি হয়ে মহারানীর কাছে। তবে এ হার মানাতে পরাজয়ের গ্লানির লেশমাত্র নেই, বরং আছে আনন্দেরই ঝরনাধারা। রানা আর শ্রাবণীর আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে প্রতি পদে পদে। তাদের আড়াইজনের সংসারে দু’জন অতিথি। রানা যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল ক্যালগেরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, ছোট ভাই রানার এখানকার সব থেকে কাছের ও প্রিয় মানুষটি এবং তার প্রিয় বাহনটি নিয়ে। রামকৃষ্ণ দাদারও বাড়ি চিটাগং। তাই মনে হয় তাদের দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধনটাও একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। আমাদের দেশের একটা প্রচলিত কথা আছে যে, দু’জন সিলেটি, দু’জন বরিশালী, দু’জন নোয়াখালী এবং দু’জন চাটগায়ী একসঙ্গে হলে কাছে, নিজের বউ কিংবা গার্লফ্রেন্ড থাকলেও নাকি তাদের ভুলতে একটুও সময় লাগে না। অবশ্য আমাদের প্রিয় রানা ও রামকৃষ্ণ দাদার সম্পর্কটা নিশ্চয় তেমন নয়। প্রার্থনা করি তাদের বন্ধুত্ব চির অম্লান থাকুক। কখন সুযোগ পাওয়া যাবে তার তো কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাই এবার তার কাছে বিনীত আকুল আবেদন সময়টা যেন একটু বাড়িয়ে দেয়া হয়। না হলে তাকে এমন অভিশাপ দেব তখন বেটা ঈশ্বর মজাটা বুঝবে কত ধানে কত চাল। যাক আবেদন একটা করে রাখলাম, সময় বাড়ানো না বাড়ানো তার একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার। আবেদন না করলে তো কোন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই তাই এই বাহানা। বাহানা না করে তো উপায় নেই, সেই ভ্যানকুভার থেকে বোর্ডিং পাস নেয়ার সময় আবদার করেছিলাম আমাদের যেন জানালার পাশে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। জেট এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা ভদ্রলোকটি কথা রেখেছিলেন। জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য মনপ্রাণ ভরে দেখা আমার সেই যেদিন থেকে বিমানে চড়া শিখেছি সেই দিন থেকেই। তবে রাতেরবেলা, আকাশ মেঘমুক্ত না থাকলে কিংবা কুয়াশায় ঢেকে গেলে সে গুড়েবালি। তবে হ্যাঁ, তার পরও একটা কিছু থেকে যায়! ইদানীং মহারানী সেখানেও ভাগ বসান। তবে ভাগাভাগি করতে সমস্যা হয় না। সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে অন্যে ভাগ বসালে সৌন্দর্যে ঘাটতি পড়ে না। বরং আনন্দটা ভাগাভাগিতে ভ্রমণের মাধুরিটা পরিপূর্ণতা পায়। তেমনিই ঘটনা ঘটেছিল সেদিনটাতে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডার গ্রীষ্মকালের এই শেষ সময়টাতেও সূর্য মামার অন্তর্ধান হতে হতে ন’টা সাড়ে ন’টা বেজে যায়। সেদিনের আকাশটা পরিষ্কার থাকার কারণে পর্বত মালার চূড়ায় সাদা মেঘের ভেলাগুলো মন মাতানো সুরের মূর্ছনায় নাচতে নাচতে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছিল পাহাড়ের চূড়ায়। দ্রুতলয়ে তাদের আগমন ও প্রস্থান এবং অন্তর্ধান কখনও বা বিরসবদন কালো পাথরের পাহাড়কে উলঙ্গ করে কখনও বা ভদ্রবেশে দর্শক মাঝে উপস্থাপন, অনাবিল আনন্দের সঞ্চার করে চলচ্ছিল। এরই মাঝে কোন কোন পাহাড়ে বরফের আচ্ছাদনে প্রখর সূর্যকীরণের বিচ্ছুরণ এক অনাবিল আনন্দের খোরাক যোগাচ্ছিল। কিন্তু আনন্দের খোরাক আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না বিমান বালার ঘোষণায়, বিমান অবতরণের প্রস্তুতিতে। তবে অল্প সময়ের এই বিমান ভ্রমণে রকি মাউন্টেনের সম্যক ধারণা পাওয়া না গেলেও রকের গঠন ও এর নিরেট রূপবৈচিত্র্যের একটা আলামত বুঝতে বাকি রইল না। কোথাও পিরামিড, কোথাও সমতল, কোথাও বৃক্ষদ্বারা আচ্ছাদিত আবার রুক্ষ রকের সমাহারের বৈচিত্র্যে ভরা অসংখ্য পর্বতের অবস্থান হাজার কয়েক মাইলজুড়ে। যাহোক সেদিন আর তেমন কিছুই দেখা বা জানার সুযোগ পাওয়া গেল না। বাকি টুকু বাকি থাক। দেখা যাক আমাদের হোস্ট মি. রানা দে এবং শৈলেন দাশ কি আয়োজন করে রেখেছে আমাদের জন্য। রামকৃষ্ণ দাদার সঙ্গে গাড়িতে বসেই পরিচয়। আলাপচারিতায় জানা গেল তিনি এখানে এসেছেন অনেক বছর হয়ে গেল। এই ক্যালগেরি শহরে সর্বসাকুল্যে শ’তিনেক বাঙালী পরিবারের বসবাস। তারা প্রত্যেকে বিপদে আপদে একে অপরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করে আসছেন। খবরটা শুনে ভালই লাগল এই ভেবে যে, অন্তত এই সুদূর কানাডার ক্যালগেরি শহরে বাঙালীদের মধ্যে রেষারেষি দলাদলি নেই। বিদেশ বিভুইয়েও বাঙালীরা দলাদলি ছাড়া থাকতে পারে না। লন্ডনের কথাই ধরা যাক না, এখানে সৌদি আরবের পর সব থেকে বেশি বাঙালীর বিদেশে বসবাস। ধর্ম কর্ম, রাজনীতি কোন খানে দলাদলি নেই! বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অনুসারীরা এখন এক থেকে চার ভাগে বিভক্ত। অন্যদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ দলাদলি করতে করতে এখন প্রায় নিঃশেষ। অন্যদের কথা আর নাই বা বললাম। যতদূর জানি নিউইয়র্ক সেখানেও একই অবস্থা। যাক সে সব কথা এখন ফিরে আসি আজকের আলোচ্যসূচীতে। চলবে...
×