ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হুমায়ুন কবির প্রিন্স

ঘুরে আসুন থান্ডার ড্রাগনের দেশে

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঘুরে আসুন থান্ডার ড্রাগনের দেশে

থিম্পু শহরটি গড়ে উঠেছে থিম্পু ভ্যালিতে যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭৫০ মিটার উঁচুতে। পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো গোছানো বাড়িগুলো দেখতে প্রায়ই একই রকম। বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রাকে পরিমিত রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা সরকার থেকেই করা হয়েছে। ছয় তলার ওপর বেশি উঁচু বাড়ি চোখেই পড়ে না। তবে প্রতিটি হোটেল থেকে পাহাড় এবং মেঘের প্রেমময় মিলন সত্যই দৃষ্টিনন্দন। আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ ভুটানের নাগরিকরা অত্যন্ত সচেতন জাতি দুই হাজার দু’শ’ পঞ্চাশ মিটার উচ্চতায় পারোভেলিতে বিমান অবতরণ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। আরও আছে ভয়-মেশানো ভাললাগার অভিনব স্পন্দন। সুদক্ষ পাইলট অসাধারণ ক্ষমতায় শূন্যে বাঁক দিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে বিমানটিকে মাটি স্পর্শ করালেন, সেও এক অবাক করার মতো অন্যরকম অনুভব। বিমান বন্দরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব নৈসর্গিক মাধুর্য যেভাবে স্বাগত জানাল তাতে নতুন এক ভুবনের ভিন্নমাত্রার আনন্দে আপ্লুত হবার মতো অবস্থা। সেখান থেকে সপ্তাশ্চর্যের কোন দেশে কিংবা স্বর্গীয় কোন আবেশে মনোমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ভ্রমণকারী হিসেবে বিমান বন্দরের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যাত্রা শুরু হলো রাজধানী থিম্পুর পথে। মহাসড়ক দিয়ে যেতে যেতে দৃশ্যমান হয় চারপাশের নির্মল প্রাকৃতিক আবহ। পাহাড়, নদী, ঘন সবুজ উঁচু নীচু পর্বত তার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে নীলাকাশের সাদা মেঘের ভেলা। মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের সঙ্গে সাদা মেঘের যে মিলন সৌধ তা পুরো পরিবেশকে করেছে অনাবিল আনন্দের এক চমৎকার হৃদয় ছোঁয়া আবেশ। থিম্পু শহরটি গড়ে উঠেছে থিম্পু ভ্যালিতে যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৭৫০ মিটার উঁচুতে। পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো গোছানো বাড়িগুলো দেখতে প্রায়ই একই রকম। বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রাকে পরিমিত রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা সরকার থেকেই করা হয়েছে। ছয় তলার ওপর বেশি উঁচু বাড়ি চোখেই পড়ে না। তবে প্রতিটি হোটেল থেকে পাহাড় এবং মেঘের প্রেমময় মিলন সত্যই দৃষ্টিনন্দন। আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ ভুটানের নাগরিকরা অত্যন্ত সচেতন জাতি। সামাজিক বিধি নিষেধকে মান্য করেই তাদের প্রতিদিনের জীবন ও কর্ম প্রবাহ শুরু করে। রাত না জাগা, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, আইন কানুন মেনে চলা, মানুষকে তার প্রাপ্ত মর্যাদা দেয়া থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদই তাদের জাতীয় জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হোটেলে ফিরে নতুন সাজে নিজেকে সতেজ করে জং থেকে ঘুরে আসাটাও এক আবেগমিশ্রিত অনুভবের দ্যোতনা। যেখানে মনোরম সন্ধ্যায় আলোয় আলোয় সজ্জিত শহরটি এক ভিন্ন মাত্রার ভাল লাগার আমেজ তৈরি করে। যে জং শহরের সঙ্গেই ভুটানের রাজাধিরাজের রাজমহল। যেখানে সর্ব সাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই বললেই চলে। দেশের সাধারণ নাগরিকরা রাজাকে স্থান দিয়েছেন একেবারে সর্বোচ্চ আসনে। যা শুধু দেবতাকেই জানায়। কিন্তু রাজা স্বয়ং তার সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করেছেন জাতীয় সংসদে। অর্থাৎ সর্ব সাধারণের কাছে। এতো গেল প্রথম দিনের থিম্পু শহর আর জং এর অভিজ্ঞতা নিয়ে ভুটানকে দেখার এক নতুন চমৎকার ঘটনা পরম্পরার কাহিনী। পরের দিনের সকাল ছিল আর এক নব প্রভাতের নতুন সূর্যোদয়। ভুটানের থিম্পু শহরে প্রথম রাত যাপন আবেগে অভিভূত করার এক আশ্চর্যবোধ। সেই স্পর্শ কাতর আবেগে সকালে বুদ্ধা পয়েন্টে দিকে রওয়ানা হওয়া। পাহাড়ের চূড়ায় বৌদ্ধ ধর্মের মহামানব গৌতম বুদ্ধের আকর্ষণীয় মূর্তি। এখান থেকে থিম্পু শহরের বার্ডস আই ভিউ এক অনির্বাণ রূপশৌর্যে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে। পাশাপাশি পুরো শহরটিতে এক চক্কর ঘুরে আসাটাও অভাবনীয় কিছু নয়। থিম্পু ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেশটির ঐতিহ্যিক আর ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক মিলন কেন্দ্র। ভুটানের প্রতœতাত্ত্বিক কীর্তি থেকে শুরু করে সামগ্রিক ইতিহাস এ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে যা সে দেশের পুরো চেহারা দর্শনার্থীদের উপহার দিবে। থিম্পু নদী যা থিম্পু চু নামে পরিচিত তার চারপাশের অজস্র জলরাশির প্রবহমান দীপ্তি যেমন পুরো পরিবেশকে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দেয় একইভাবে নদীর উপরে ব্রিজে গাড়ি বহরের আসা-যাওয়া ও অন্য রকম এক জাগতিক কর্মযজ্ঞে পূর্ণ করে। সেখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের আইনানুগ কার্যবিধিরও এক সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। এ ধরনের মনোরম দৃশ্য অনুধাবন করতে গিয়ে সময়ের মিছিল যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ভ্রমণকারী তা বুঝতেও পারে না। সেই এক অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ যাকে কোন ভাষা দিয়ে বর্ণনা করা যায় তৃতীয় দিন সকাল বেলায় যাত্রা শুরু হলো পুনাখার পথে। তবে এর জন্য দূতাবাসের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র সংগ্রহ করা আবশ্যক। সেটা করেই পুনাখার পথে এগিয়ে যাওয়া। পথিমধ্যে আরও একটি শহর দোচুলা পার হয়ে যেতে হয়। এখানে সব চাইতে আকর্ষণীয় আর দর্শনীয় শুভ প্রভাতের নব সূর্যোদয়। তা দর্শনার্থীর আবেশকে হৃদয়স্নাত অনুভূতি দিয়ে আপ্লুত করে রাখে। সেই এক অভাবনীয় সৌন্দর্যের অবগাহন। সূর্য ওঠা যেমন প্রতিদিনের একইভাবে নিত্যনতুন অনুভবেরও। মেনে আরও নব আনন্দে ভরে উঠে এই সূর্য ওঠার মনোরম দৃশ্য দেখে। অরুণোদয়ের স্নিগ্ধ আবেশে নিজেকে পরিপূর্ণ করার পর প্রয়োজন পড়ে প্রাতঃরাশের। সেই নিবিষ্টতায় সকালের নাস্তাটি সেরে ফেলা। পরবর্তী গন্তব্য পুনাখা। পুনাখা জং এবং ঝুলন্ত সেতুর মুগ্ধতায় সময়ের মিছিল কিভাবে এগিয়ে যায় সেটাও বিস্ময়কর। আর পথের দু’পাশে নৈসর্গিক বৈভ বের বিমুগ্ধতায় নিজেকে সম্পূর্ণ করা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবাই যায় না। পর্যায়ক্রমিক দর্শনীয় আর আকর্ষণীয় স্থানে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এসে যায় পার। ভুটানের আরও একটি অনবদ্য সৌন্দর্য সৌধ। উচ্চতা প্রায় সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার মিটার অর্থাৎ ১৩ হাজার ফিট। যেখানে মেঘের সঙ্গে মিতালি করে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। আর বরফ পড়ার সময়ে এলে তো কথাই নেই। সাদা বরফের সঙ্গে নিজের ছবি তুলে মুহূর্তটি স্মৃতিময় করেও রাখা যায়। বরফ পড়ার সময় আসলে শীতের কাপড় সঙ্গে থাকা বাঞ্ছনীয় সময়ের স্বল্পতায় যদি তাড়িত হতে না হয় তা হলে হা ভ্যালিতে ঘুরে আসাও এই ভ্রমণকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। হা ভ্যালি ভুটানের অন্যতম উঁচু উপত্যকা যেখানে হাইকিং ছাড়া যাওয়া সম্ভব। সারাদিনের ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীরে একটা টানা ঘুমের বড় বেশি প্রয়োজন হয়। ফলে বাকি যাত্রাটা তোলা থাকে পরের দিন সকালের জন্য সতেজ আর উৎফুল্ল চিত্তে তৈরি হতে হয় তিন ঘণ্টার হাইকিং করার জন্যে। যেখানে উঠতে দুই ঘণ্টার আর নামতে ১ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। টাইগারস নেস্টকে উপভোগ করতে ওঠা-নামার এই কষ্টটুকু স্বীকার করতেই হবে। আর এটা করতে পারলেই ভুটানের সবচাইতে জনপ্রিয় জায়গা থেকে অবারিত সৌন্দর্য দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হবে না এই টাইগারস নেস্ট ৩১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যা পারো ভ্যালি থেকে ৯০০ মিটার উঁচু। কথিত আছে অষ্টম শতাব্দীতে ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক ধর্মগুরু পদ্মমাসম্ভবা যে বাঘের পিঠে চড়ে পাহাড়ের চূড়া অবধ যান সেই বাঘের নামেই এর নামকরণ হয় টাইগারস নেস্ট। ধারণা করা হয় সতেরোশ’ শতাব্দীতে বর্তমান স্থাপনাগুলো নির্মিত হয়। এখানে যাবার সবচাইতে সুবর্ণ সময় সকাল বেলা। শান্ত প্রকৃতি, স্নিগ্ধ আবহ সর্বোপরি অপরূপ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য পথচলার অনুষঙ্গ হিসেবে ভাবা যায়। যা প্রত্যেক পর্যটককে নানামাত্রিক আনন্দে বিমোহিত করে দেয়। উঠবার পথে বাড়তি আয়োজন হিসেবে যোগ হয় পাহাড়ের ঝর্ণাধারা কিংবা বিশ্রামের জন্য ছোট্ট ক্যাফেটারিয়া। বিকেল বেলায় পুরো শহরটা ঘুরে বেড়াতে বেশ মজাই লাগে, সেখান থেকে বিমানবন্দর অথবা আরও দূরের স্নোমাউনটেন যেখানে পাহাড়ের মাথায় সারা বছর বরফ থাকে উপভোগ করা আর বাড়তি আনন্দ হিসেবে যোগ হতে পারে ছবি তোলাও। যতখানি দর্শন করা সম্ভব ছিল সবটুকু সৌন্দর্য অন্তর আর স্মৃতিতে অম্লান করে নিজ মাতৃভূমিতে ফেরার তাগিদ অনুভব করা ও ভ্রমণের অবিচ্ছেদ্য তাড়না। স্মৃতি বিজড়িত এই ভুটানের মনোরকম ধর্মনীয় স্থানগুলো নিরবচ্ছিন্ন আনন্দই দেবে না পাশাপাশি স্বদেশের উন্নয়নের গতিধারায় এই অনুপম ঐশ্বর্য যদি কোনভাবে সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে সেটাও বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরী। এই বোধে দর্শনীয় ভুটানকে বিদায় দিয়ে আপন ঠিকানায় আকাশ পথে উড়াল দেয়াই পরবর্তী গন্তব্য।
×