ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সামরিক নয়, কূটনৈতিক পথেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সামরিক নয়, কূটনৈতিক পথেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রোহিঙ্গা সমস্যাকে ব্যবহার করে দেশে অপরাজনীতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সোমবার সচিবালয়ে তথ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যা শোচনীয়, ত্রাণ দিতে পারছে না সরকার। বেগম জিয়ার কথা শুনে মনে হয় এই মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্ব এবং জাতিসংঘ যে ব্যাপক তৎপরতায় কাজ করছে, তা তিনি দেখতে পারছেন না বা দেখতে চাচ্ছেন না। বরং জঙ্গী দমন আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা ব্যবহার করাই তার চক্রান্ত। তাতে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কোন সমাধান তার কাম্য নয়, বরং রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে সরকারকে ঘায়েল করার এক চক্রান্তের জাল বোনার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ খুঁজছেন তিনি। রোহিঙ্গা সমস্যা জাতিগত সমস্যা, কোন ধর্মীয় সমস্যা নয়- উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ফেরত পাঠানো এবং নিরাপত্তা মর্যাদার সঙ্গে তাদের নিজ দেশে পুনর্বাসনই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। এজন্য তাদের দেশে নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আর আমাদের সরকার এ বিষয়ে সামরিক নয়, কূটনৈতিক তৎপরতায় বিশ্বাসী। তথ্যমন্ত্রী বলেন, দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির সঙ্গে আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় তথা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমাধানের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব বিবেক আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আশা করি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শরণার্থীদের নিরাপদে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা রাজনৈতিক বহুমাত্রিকতা থাকলেও শেখ হাসিনা মানবতা ও মনুষ্যত্বকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা একান্ত প্রয়োজন। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা নিয়ে রাজনীতি করছেন না, অন্যরাও এ নিয়ে রাজনীতি করবেন না। সেটাই একান্তভাবে কাম্য। মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ সমস্যার ফলে উদ্ভূত উদ্বাস্তু সমস্যাকে কূটনৈতিক মুন্সিয়ানার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। মানবিক সঙ্কটকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলা, ঘোলা জলে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্রের জাল বোনা এবং দলীয় ও পারিবারিক ফায়দা লোটার অপরাজনীতিও মোকাবেলা করতে হবে। যারা এ অপরাজনীতি করছেন তারা রোহিঙ্গাদের শত্রু, দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু। মন্ত্রী বলেন, চলমান জঙ্গী দমন প্রক্রিয়াকে আড়াল করার অপপ্রয়াসের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। উদ্বাস্তু সমস্যাকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার বৈধ সরকারের বদলে একটি অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠার চক্রান্তও প্রতিরোধ করতে হবে। সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টির উস্কানি রোধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার মধ্য দিয়ে দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ছড়ানোর ষড়যন্ত্র কঠোরভাবে দমন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারের মানবিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ তুলে ধরে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এর মধ্যে আমরা যে বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন, গণহত্যা তদন্তে জাতিসংঘ কমিটি গঠন করা, অব্যাহত সংলাপ, সকল আন্তর্জাতিক সংস্থাকে আরও সক্রিয় করা। লিখিত বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সে দেশের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ গণহত্যা ও নির্যাতন চালালে গত ৩ সপ্তাহে প্রায় ৪ লাখ মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। প্রথমেই আমরা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনে এবং জীবন রক্ষায় স্থানান্তরকালে যেসব নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের সকলের আত্মার শান্তি কামনা করি, তাদের পরিজনদের প্রতি গভীর শোক জানাই এবং জাতিগত নির্মূলের চক্রান্ত ও নিষ্ঠুর গণহত্যার তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা প্রকাশ করি। মিয়ানমারের এ সমস্যা নতুন নয়। সামরিক জান্তার জাতিগত নিপীড়নের এক কলঙ্কজনক ইতিহাস। ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তারা ক্ষমতা দখল করলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এরপরও বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিরোধটি শেখ হাসিনার সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে মীমাংসা করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি মিয়ানমার সরকার পরিচালিত ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে পরিচালিত অভিযানে সহিংসতার শিকার হয়ে ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। পরে তাদের অধিকাংশকেই প্রত্যাবাসন করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থী আসে। এদের মধ্যে অধিকাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ শরণার্থীই ফেরত গেলেও রয়ে যায় প্রায় ৩৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। এবং এর পরে বিভিন্ন সময় একই ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে ক্রমাগতভাবে চার লাখ মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রমতে অর্থাৎ আজ এসময়ে প্রায় ৮ লাখ মিয়ানমার নাগরিক কক্সবাজারে অস্থায়ী ক্যাম্পে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ইতোপূর্বে ফেরত নেয়ার মাধ্যমে তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, সে বিষয়টি সুস্পষ্ট। ২৫ আগস্ট ২০১৭ এর পূর্বে বাংলাদেশের তৎপরতা : শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা গ্রহণ করে। বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগের মধ্যে সীমান্ত পরিস্থিতি উন্নতির জন্য ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার মিয়ানমারের কাছে দুটি প্রস্তাব করে। একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা সংলাপ চুক্তি ও অপরটি সীমান্ত লিয়াজোঁ অফিস প্রতিষ্ঠা। এখনও পর্যন্ত মিয়ানমার এ বিষয়ে কোন মতামত দেয়নি। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির সঙ্গে মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে দুবার বৈঠক করেন। বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। পররাষ্ট্র সচিব পাঁচবার মিয়ানমার সফর করেছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার একযোগে তিন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন: মানবিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক। মানবিক পদক্ষেপ : ‘সবার ওপরে মানবতা’র মন্ত্রে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়াবহ নৃসংশতার শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের খাদ্য, বাসস্থান, অস্থায়ী আশ্রয়, চিকিৎসাসহ সকল ধরনের মানবিক সাহায্য দেয়া নিশ্চিত করেছেন, নিয়েছেন ২২টি পদক্ষেপ। এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থা এগিয়ে এসেছে, তাদের আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একনজরে ত্রাণ ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনা : এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার ১৪টি পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮০০ মেট্রিক টন খাদ্য ও ৩২ লাখ টাকা সমমূল্যের সরকারী ও বেসরকারী ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা সরাসরি ১ লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে খাদ্য যোগান দিচ্ছে। ৭০ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মাতার বিশেষ পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০০০ একর জমিতে শরণার্থীদের অস্থায়ী আবাসন নির্মাণ হচ্ছে। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নির্মিত হয়েছে ১৬ হাজার শৌচাগার। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ৪টি বৃহৎ পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। শিশুদের জন্য টিকা ও ভিটামিন সরবরাহ করা হচ্ছে, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে যোগান দেয়া হচ্ছে প্রতিষেধক, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীও সরবরাহ করা হচ্ছে। নেয়া হয়েছে বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা। নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি নিরাপত্তা চৌকি, ৪২টি নিরাপত্তা দল ভ্রাম্যমাণ পেট্রোল পরিচালনা করছে। সকল ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সমন্বিত হচ্ছে। সব শরণার্থীকে নিবন্ধন করতে হবে। সরকার নির্ধারিত আশ্রয় স্থল ছাড়া শরণার্থীদের অন্যত্র গমন আইনবিরুদ্ধ। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও শরণার্থী আশ্রয় দেয়াও আইনবিরুদ্ধ এবং কোন শরণার্থীকে অন্য কোথাও পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে। উদ্বাস্তু শিবিরের কোন নারীর সঙ্গে বিবাহ আইনবিরুদ্ধ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশ ত্রাণ কার্যক্রমে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে নতুন ৩ লাখ মিয়ানমার শরাণার্থীর জন্য অন্তত ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার প্রয়োজন। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ৪০ লাখ ডলার, ডেনমার্ক ৩০ লাখ ডলার দেবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশের রেডক্রিসেন্ট বিশ্ব রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সদস্য ১৯০টি দেশের কাছ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার আহ্বান করেছে। কূটনৈতিক পদক্ষেপ ॥ শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার সূত্রপাতের পর থেকেই মিয়ানমারকে সহিংসতা বন্ধ করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান, বিতাড়িত নাগরিকদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ও কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে সরকার। আঞ্চলিক কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ভারত ও চীনসহ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলো উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে উদ্যোগী হয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির ফলে ইতোমধ্যেই তুরস্কের ফাস্ট লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। এর সঙ্গে এ যাবত জাপান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাতার, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ভাটিক্যান, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও আই সি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে যেখানে রোহিঙ্গা নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ; অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের প্রশংসা করা হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার ৪২ দেশের কূটনীতিকবৃন্দ এবং ৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটির রাস্তায় হেঁটে কক্সবাজারের উখিয়া এবং বান্দরবনের নাইক্ষ্যংছড়ি রোহিঙ্গা শিবিরে যান। নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনিয়ের বলেন, এটি মানবিক বিপর্যয় এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করতে হবে এত মানুষকে উষ্ণতার সঙ্গে গ্রহণ করার জন্য। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিনা সোয়েমারনো বলেন, ‘রোহিঙ্গা সঙ্কটে ইন্দোনেশিয়া সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে আছে, থাকবে।’ ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া, যাতে তারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে।’ এখানেই শেষ নয়, গত ৯ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্তনিও গুতেরেস মিয়ানমারের সহিংসতাকে ভয়াবহ বিপর্যয় এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসতা বন্ধ করে নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক পদক্ষেপ ॥ ভয়াবহ এই মানবিক বিপর্যয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে শান্তির দূত হয়ে ছুটে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার কক্সবাজারের উখিয়া ও কুতুপালং শিবিরে মিয়ানমার নাগরিকদের মাঝে ত্রাণ বিতরণকালে তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের শরণার্থীদের পাশে রয়েছি এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাব, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের দেশে ফিরছে আমরা পাশে রয়েছি। তারাও মানুষ এবং মানুষ হিসেবেই তাদের বাঁচার অধিকার রয়েছে। তারা কেন এত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে?’ শরণার্থী শিবিরগুলোতে ছুটে গেছেন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যবৃন্দ ও রাষ্ট্রের উর্ধতন কর্মচারীবৃন্দ। এবং ত্রাণ তৎপরতায় সহযোগী সব সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ রাতদিন অক্লান্ত সেবায় নিযুক্ত রয়েছেন। সেই সঙ্গে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। খোলা হয়েছে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। ঠিক এমনিভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ মানবিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তখন মিয়ানমারে চলমান এই জাতিগত নিধন ও তার ফলে বাংলাদেশে শরণার্থী সমস্যার ভয়াবহতার কয়েকটি মাত্রা তুলে ধরতে গেলে বলতে হয়- মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং প্রতিবেশীর আভ্যন্তরীণ সমস্যার ফলে উদ্ভূত উদ্বাস্তু সমস্যাকে কূটনৈতিক মুন্সিয়ানার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। মানবিক সঙ্কটকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলা, ঘোলা জলে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্রের জাল বোনা এবং দলীয় ও পারিবারিক ফায়দা লোটার অপরাজনীতিও মোকাবেলা করতে হবে। চলমান জঙ্গী দমন প্রক্রিয়াকে আড়াল করার অপপ্রয়াসের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। উদ্বাস্তু সমস্যাকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার বৈধ সরকারের বদলে একটি অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠার চক্রান্তও প্রতিরোধ করতে হবে। সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টির উস্কানি রোধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার মধ্য দিয়ে দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত ছড়ানোর ষড়যন্ত্র কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মিয়ানমারের জাতিগত নিধনযজ্ঞ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে পারে। দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা যেন বিঘিœত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্ব যখন শেখ হাসিনার পাশে, তখন খালেদা জিয়া ও বিএনপির অপরাজনীতি দেশ ও রোহিঙ্গাদের ক্ষতি করছে। রাজনীতিকে পাশে সরিয়ে মানবতাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছেন আর খালেদা জিয়া তার এ ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় দেশের ও রোহিঙ্গাদের শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে এ অপরাজনীতি পরিহার করতে হবে ॥ এদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলছেন, ‘সরকারের দুর্বল কূটনৈতিক তৎপরতার কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যা শোচনীয়; ত্রাণ দিতে পারছে না সরকার।’ বেগম জিয়ার কথা শুনে মনে হয় এই মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পাশাপাশি বিশ্ব এবং জাতিসংঘ যে ব্যাপক তৎপরতায় কাজ করছে, তা তিনি দেখতে পারছেন না বা দেখতে চাচ্ছেন না। বরং জঙ্গী দমন আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য ‘রোহিঙ্গা সমস্যা’ ব্যবহার করাই তার চক্রান্ত। তাতে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে- কোন সমাধান তার কাম্য নয়, বরং রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে সরকারকে ঘায়েল করার এক চক্রান্তের জাল বোনার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ খুঁজছেন তিনি। অন্যের সমস্যা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আমরা বর্ডার বন্ধ করে দিয়ে এ সমস্যা এড়াতে পারতাম। কিন্তু মানবতা ও মনুষ্যত্বকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। কারণ, মানবিক সঙ্কট নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার রাজনীতি করে না। সরকার প্রাথমিকভাবে মানুষ বাঁচানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, আশ্রয়-খাদ্য-চিকিৎস্যা-ত্রাণ দিচ্ছে, নিজস্ব সম্পদ দিয়ে সাহায্য করছে। দেশের মানুষ এগিয়ে এসেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে এসেছে এবং আসছে। সেখানে দুঃখের বিষয়, বিএনপি ও অনেকেই এনিয়ে রাজনীতি করছে, মিথ্যাচার করছে, এতে দেশের ক্ষতি। কারণ এতে সমাধানের বদলে, সমস্যা জিইয়ে থাকতে পারে।
×