ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অমৃতলোকে ‘নিসর্গসখা’ লেখক দ্বিজেন শর্মা

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অমৃতলোকে ‘নিসর্গসখা’ লেখক দ্বিজেন শর্মা

দ্বিজেন শর্মা, প্রকৃতি পুত্র, বৃক্ষপ্রেমী, উদ্যানবিদ নানা নামে তিনি খ্যত। প্রকৃত পক্ষে একজন নিখাদ মানুষ। মায়ের উৎসাহে হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু ভাগ্য নির্ধারিত ছিল প্রকৃতি প্রেম; আর এ নিয়ে পড়াশোনা। তাই যোগ্যতা থাকার পরও ডাক্তারি তাঁর পড়া হয়নি। পড়তে হয়েছে বোটানি। দ্বিজেন শর্মা নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৃক্ষের সতেজতা, সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকে গেছেন ‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ...’এই আহ্বান আমৃত্যু জানিয়ে গেছেন দ্বিজেন শর্মা। সবুজ দেশ আর সবুজ মানুষ গড়তে কাজ করে গেছেন তিনি। বৃক্ষপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মা অনেক গাছ লাগিয়েছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। গাছ চিনিয়েছেন। সবুজ প্রকৃতির জন্য আজীবন লড়েছেন। এই প্রকৃতিপ্রেমী গত শুক্রবার রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই ‘নিসর্গসখা’। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ফরাসী লেখক আঁতোয়ান দ্য সাঁৎ ঝুপেরির দ্য লিটল প্রিন্স ছিল দ্বিজেন শর্মার একান্ত প্রিয় বই। প্রায় যেন রূপকথার বই। খুদে রাজকুমারের সেই উক্তি অনুরণন তুলেছিল দ্বিজেন শর্মার অন্তরে, ‘কেবল হৃদয় দিয়েই দেখা যায় সঠিকভাবে’। তারপরই আছে সরল কিন্তু গভীর চিন্তাসম্পন্ন বক্তব্য, ‘জীবনে যা প্রয়োজনীয় সেসব চোখে দেখা যায় না’। আমরা মেতে থাকি দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী নিয়ে আর দ্বিজেন শর্মা খুঁজে ফিরেছেন গাছের পাতার কম্পন, বুঝতে চেয়েছেন কী কথা বলে ফুলদল, জীবন মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন প্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে এবং অদৃশ্যমান সম্পদের সন্ধান দিতে চেয়েছেন সবাইকে, বিশেষভাবে তরুণদের, কম বয়সীদের, যেমনটি চেয়েছিল লিটল প্রিন্সও। ১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ভিষক চন্দ্রকাণ্ড শর্মা এবং মাতার নাম মগ্নময়ী দেবী। বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন, আর মা ছিলেন সমাজসেবী। শৈশবে পাথারিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক, আর সেখান থেকেই হয়ত গাছপালার প্রতি তার অসীম ভালবাসা জন্মে। কবিরাজ বাড়ি’ বলে বাড়ির বাগানেই অজস্র গাছগাছালি ছিল, তার মাঝে ছিল স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, মধুমালতীসহ নানা রঙবেরঙের ফুল। বসন্ত শেষের বৃষ্টির পর সারা বাড়ি যখন ফুলে ফুলে ভরে উঠত, দ্বিজেন শর্মা তখন সকালে পূজার ফুল তুলতেন। সে সময়ই মনের অজান্তে দ্বিজেন শর্মাও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। শৈশবেই গ্রামের পাঠশালায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। তারপর করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। যদিও মায়ের ইচ্ছে ছিল তিনি বড় হয়ে ডাক্তার হবেন, কিন্তু প্রকৃতিপ্রেম তাঁকে উদ্ভিদবিদ হতে আকৃষ্ট করে। আর তাই কলকাতা সিটি কলেজে স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (১৯৫৮) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দ্বিজেন শর্মা। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকাস্থ নটর ডেম কলেজে। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান মস্কো। তিনি চল্লিশটিরও বেশি বই অনুবাদ করেছেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের প্রবাস জীবনকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি তিনি। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগের কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর, যাকে তিনি দুর্লভ সৌভাগ্য মনে করেন। ১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবাকার্যে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। এক ধ্যানমগ্ন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা কেমন করে বয়স নির্বিশেষে সবার দ্বিজেনদা হয়ে উঠেছিলেন, সে মন্ত্র শুধু তাঁরই জানা ছিল। যাকেই দেখতেন, তাকে আপন করে নিতেন। যেন কতকালের চেনা মানুষ, কি শিশু, কি যুবক; কি নারী, কি পুরুষ। তাঁর ধমনিতে সঙ্গীতের সুর, যেন কোন মহালোকের অর্চনায় সদা অনুরণিত সে সঙ্গীত। কি পৌরাণিক, কি আধুনিকÑ সর্বকালের প্রকৃতি দর্শনে তাঁর আগ্রহ অপার। দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মানবমন, সমাজ ও উদ্ভিদরাজ্যের নিগূঢ় রহস্য আর তা সাহিত্যের স্বর্ণজালে মুড়ে উপহার দিয়েছেন নতুন, অনেকটা প্রকৃতিবিমুখ প্রজন্মকে। বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। একাধারে শিক্ষক, অনুবাদক, বিজ্ঞান লেখক এবং প্রকৃতিবিদ। সব ছাপিয়ে তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক। প্রকৃতিই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন তিনি। অন্য বিষয়েও লিখেছেন তিনি। বৃক্ষপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মা অনেক গাছ লাগিয়েছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। সবুজ প্রকৃতির জন্য লড়ে গেছেন। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখা তার আকরগ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’। তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলো যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’ ইত্যাদি। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার জীববিদ্যা বিভাগের অনুবাদক এবং সম্পাদক (২০০১- ২০০৩) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমির একজন সম্মানিত ফেলো। দ্বিজেন শর্মা তার অবদানের কারণে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সংবর্ধিত হয়েছেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। ড. কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ (২০১৫) বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
×