ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোয়ালিয়া হত্যা দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বোয়ালিয়া হত্যা দিবস আজ

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ আজ ১৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। দুঃস্বপ্নের এক কালো দিবস চাঁপাইনবাবগঞ্জের বোয়ালিয়াবাসীর জন্য। এই দিনে ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাকা- ঘটিয়েছিল পাকি হানাদার বাহিনী। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ১৫২ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে বিজয় উল্লাস করেছিল। রেহাই পায়নি নিষ্পাপ শিশুরাও। মহানন্দার পানি লাল হয়ে উঠেছিল। তাই দিনটিকে বোয়ালিয়া হত্যা দিবস বলা হয়। জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের স্বাধীনতাকামী মানুষকে একাত্তরের সেই বীভৎসরূপ স্মরণ করিয়ে দেয় দিনটি। এই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বার বার নাজেহাল ও তাড়া খেয়ে পাকিরা বেপরোয়া হয়ে প্রতিশোধ নিতে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বোয়ালিয়ার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার উপর। একাত্তরের এপ্রিলে পুরো জেলা পাকিদের হাতে চলে যাবার পর তারা একাধিক উল্লেখযোগ্য স্থানে ক্যাম্প করে বাঙালী হত্যায় নেমে পড়ে। এমনি একটি ক্যাম্প তৈরি করে পাকিরা রহনপুর এ বি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি হানাদাররা বোয়ালিয়া-চৌডালা-নন্দলালপুর ও আড়গাড়া হাটে শক্তি ডিফেন্স তৈরি করে। উদ্দেশ্য একটাই আশপাশের এলাকায় গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালাতে প্রস্তুতি। এই সময়ে বাংলার দামাল ছেলেরা এসব ছাউনিতে বার বার অভিযান চালিয়ে গণহত্যা ও ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে থাকে। এমনকি শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ বোয়ালিয়া বাজারে হানাদারদের শক্ত বাংকারে হানা দিয়ে ১০-১২ পাকিস্তান সেনার প্রাণ কেড়ে নেয়। অন্যরা মহানন্দা পেরিয়ে পালিয়ে যাবার সময় পানিতে ডুবে মারা যায়। হানাদারদের লাশ প্রতিদিন এই অঞ্চল থেকে পৌঁছতে থাকে ঢাকা এয়ারপোর্টে। পাকিদের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের ট্রুপ বিব্রত হয়ে ছুটে আসে রহনপুরে। নির্দেশ দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর মরণ কামড় দেবার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পাবে কোথায়- তারা গেরিলা হামলা দিয়ে হানাদারদের ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে নিরাপদ ব্যবধানে মিলিয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর দোসরদের পরামর্শে মরণ কামড় দেবার লক্ষ্যে মহানন্দা পেরিয়ে এসে বোয়ালিয়া ডিফেন্স পাকাপোক্ত করে। উদ্দেশ্য পুরো বোয়ালিয়া ইউপির বিভিন্ন গ্রামে অনুপ্রবেশ করে প্রতিশোধ নিতে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসযোগ। সেই মোতাবেক তারা ১৯ সেপ্টেম্বর-৭১, রবিবার, স্বয়ংক্রীয় ভারী অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বোয়ালিয়া ইউপির গ্রামেগঞ্জে। একই সঙ্গে হানাদার বাহিনী ১৬টি গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও জ্বালাও পোড়াও চালাতে থাকে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে কিশোরী যুবতী ও সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু নিয়ে বাইরে আশামাত্র তাদের গুলি করে হত্যা করে। মেয়েদের রাস্তার ওপর ধর্ষণ করে। শিশুদের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা দিতে গিয়ে নির্বাক হয়ে পড়ে। এক কথায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১৬টি গ্রামের মানুষ জলন্ত ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে। গৌরীপুর, দরবারপুর, ঘাটনগর, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণপুর, নওদাপাড়া, বোয়ালিয়া, বৈরতলী, কাঞ্চনতলা, বড়বঙ্গেশ্বরপুর, বঙ্গেশ্বরপুর, বাবুপুর, চকমজুমদার, নরশিয়া, পলাশবনা, মাহীশুর, আলমপুর গ্রামের বহু পরিবারের বংশ সাবাড় হয়ে গেছে। গম্ভীরা গানের নানাখ্যাত মরহুম কৃষিবিদ কুতুবুলের স্ত্রীসহ সবকটি সন্তান পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হন। যে সব শহীদ পরিবারের দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন এখনও কোন কথা বলতে চান না। সেদিনের নৃশংসতা তাদের আজও তাড়া করে ফিরে। এছাড়া এসব গ্রামের পথ চিনিয়ে যেসব রাজাকার, আলবদর, হানাদারদের নিয়ে এসেছিল তাদের আজও বিচার হয়নি। এদের ভয়ে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা কথা বলতে চান না।
×