ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অস্তিত্ব সঙ্কটে চলনবিল

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অস্তিত্ব সঙ্কটে চলনবিল

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার খ্যাত দেশের একমাত্র প্রবাহমান চলনবিল আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ ও ফারাক্কার প্রভাবে দেশের বৃহত্তম এ বিলটির আয়তন ছোট হয়ে আসছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপপ্রভাবে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাই চলনবিলে অঞ্চলের ৫০ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকায়ও ঘটেছে ব্যাপক বিপর্যয়। ইম্পেরিয়াল গ্যাজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া সূত্রে জানা যায়, এককালে নাটোর জেলার সিংরা, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল লাইন স্থাপিত হলে চলনবিল ভাগ হয়ে যায়। এ রেল লাইনের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়। বর্তমানে কালের গর্ভে সঙ্কুচিত হয়ে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ জেলার ২২ নদী ও অসংখ্য খাল-বিল নিয়ে বিস্তৃত চলনবিল। ১২ মাসই জলধারা প্রবাহমান হওয়ায় তাই এটিকে বলা হয় চলনবিল। ১৯০৯ সালের জরিপে বিলের বিস্তৃতি ছিল ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩শ’ ৮৮ বর্গকিলোমিটার। চলনবিল অঞ্চলের ৪ জেলার আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, বাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা নদীসহ ১৮টি প্রধান খাল নিয়ে গঠিত। এছাড়াও শতাধিক ছোট খাল-বিল চলনবিলের অংশ হিসেবে রয়েছে। একসময় চলনবিলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। চলনবিলে কৈ, মাগুর, বাচা, রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস, কালিবাউস আইড়, রিটা, বাগাইর, চিতল, ফলি, বোয়াল, পাবদা, টেংরা, গলদা, শোল, গজার, টাঁকি, ভেদা, খসল্লা, চিংড়ি, গলদাচিংড়ি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, বাঁশপাতা, খৈরা, হাসি, মোয়া, চাঁন্দা, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যেত। চলনবিলের খাল-বিলে এক সময় মানুষ হাত দিয়েই প্রচুর মাছ ধরত। এ কারণে চলনবিল এলাকায় হাজার হাজার জেলে পরিবার সেই প্রাচীন আমলেই বসতিস্থাপন করে। এক সময় চলনবিল বালিহাঁস, তিরমুল, মুরগি-হাঁস, খয়ড়া, মানিকজোড়, ডুটরা, চাপাখি, নলকার, সাদাবক, কানাবক, ফেফি, টাইক, চখা, বকথেনু, কাছিচোরা, রাতচোরা, ভুবনচিল, মাছরাঙাসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখির বিচরণক্ষেত্র ছিল। চলনবিলে পানি আর পাখি যেন সমানে সমান ছিল। যে কেউ হাত দিয়েই পাখি ধরতে পারত। চলনবিলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে থাকত বিভিন্ন প্রজাতির পদ্ম-শাপলা-লতাগুল্মের আড়ালে নানা প্রজাতির কচ্ছপ, ঝিনুক আর শুশুক। এ সময় চলনবিলের উর্বর মাটিতে প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, খেসারি, মসুর, সরিষা, পাট, পেঁয়াজ, রসুনের ব্যাপক আবাদ হতো। এ অঞ্চলে মাইটাগরল, দিঘা, আজলদিঘা, হিলদিঘা, টেপা, বাঁশিরাজ, কাজল, আউশ, বরণ, আমন, শরসরী, আশ্বিনা ধান প্রচুর পরিমাণে চাষ হতো। চলনবিলে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, নানা জাতের ফল ও পশুর আবাসস্থল ছিল। এখন আর এ অবস্থা নেই। খাল-বিল ভরাট হতে হতে এখন প্রবাহমান একমাত্র বিলটিতে সারা বছরও পানি থাকে না। ইতোমধ্যেই অন্তত ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে সংযোগ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিলের পানি এলাকার আয়তন অনেক কমেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এছাড়া পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক বিভাগ অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করায় বিলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড চলনবিল এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ফসল রক্ষার উদ্দেশ্যে বিলের উৎসমুখে সুইজ গেট, রাবারড্রাম, বাঁধ নির্মাণ করায় বিলটির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পরেছে। বড়াল, আত্রাইসহ কয়েকটি নদীতে ক্রসবাঁধ নির্মাণ করায় চলনবিলের স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে করেছে রুদ্ধ। যার কারণে এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। ২০০১ সালে চলনবিলের উপর দিয়ে দীর্ঘ ৫৫ কিলোমিটার হাটিকুমরুল-বনপাড়া সড়ক নির্মিত হওয়ায় চলনবিলকে উত্তর-দক্ষিণ ২ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এ সড়ক নির্মাণের কারণে চলনবিলের পরিবেশও ধ্বংস হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। চলনবিল উদ্ধার আন্দোলনের সদস্য সাংবাদিক রকিবুর রহমান টুকুন এ বিষয়ে জানিয়েছেন, কানেকটিভিটি বাড়াতে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে মহাসড়ক, চাটমোহর-মান্নাননগর সড়কসহ অনেক সড়ক নির্মাণের কারণে চলনবিলের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নষ্ট হয়েছে। এতে বিলাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হওয়ায় এ অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষের জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ নাজমুল ইসলাম জানান, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করায় চলনবিলের দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি এসেছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে চলনবিলের প্রাণ প্রকৃতি ও বিলনির্ভর মানুষের জীবন জীবিকায়। তিনি আগামীতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।
×