ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:১০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

আশ্বিন মাসের প্রথম দিন সূর্য যেন উঠে এলো ঢাকার ঠিক মাথার ওপরে! তা না হলে এত গরম লাগে? শরতের একটি মাস চলে যাওয়ার পরও যদি ঢাকার তাপমাত্রা হঠাৎ ছত্রিশে উঠে যায় তবে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা হওয়ারই কথা। পাখি আর অন্য প্রাণীদের গরমে কষ্ট পাওয়ার কথা কি আর আমরা ভাবি। যা হোক, গত সপ্তাহে পর পর দুদিন বেশ ঝুম বৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকায় আবার যে কে সেই গরম। শনিবার ছত্রিশে উঠে যাওয়ার পর আবার রবিবারে সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ, কোথাও কোথাও নেমে আসে স্বস্তির বৃষ্টি। ভূমিকম্প নয়, তবু ভগ্নদশা! ঢাকার রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে কখনও কখনও এমন প্রশ্নও মনের ভেতর উঁকি দেয়Ñ শহর কাকে বলে? আর যে শহরটি রাজধানীর গৌরবে আসীন তার চেহারাও কেন এমন উদভ্রান্ত! নিশ্চয়ই শহরের ভেতর এমন বেশ কিছু স্থান রয়েছে যা ছবির মতোই সাজানো গোছানো, ছিমছাম। ছবির মতোই সুন্দর। আবার নাকে রুমাল চেপে শুধু চোখ খোলা রেখে এই ঢাকারই কোন কোন এলাকা পরিদর্শনে গেলে মনে হবে Ñ স্বপ্ন দেখছি নাতো! এ যে রীতিমতো ইউরোপ! একই অঙ্গে বিচিত্র রূপ এই শহরের। কোথাও আবার সে রুক্ষ্ম এবং বিশৃঙ্খল। যে এলাকায় দিনে লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করে, বিমানবন্দর থেকে নেমে কোন বিদেশী যদি ইন্টারকন্টিনেন্টাল- সোনারগাঁও হোটেলে আসতে চান তবে যে যায়গাটা তাকে অতিক্রম করতেই হবে সেটি দেখতে যদি বিদঘুটে কিম্ভূতকিমাকার লাগে, তাহলে গোটা রাজধানীর স্ট্যাটাস বা ভাবমূর্তি কী দাঁড়ায়। রাজধানী না হোক রাজরানীর মতো অভিজাত চাকচিক্যময়, কিন্তু কেন দেখাবে তাকে চাকরানির মতো? ফার্মগেট থেকে কারওয়ানবাজার যেতে ডানে-বাঁয়ে দু-দশ মিনিট তাকালেই যে কারুরই ধারণা হবে এটি হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন শহর কিংবা নতুন নির্মীয়মাণ নগরী, তাই এত জঞ্জাল আর কংকালের আধিক্য। একটি মার্কেট ভবনের বাইরের চেহারা যদি জবরজং হয়, তার মুখ-মাথার চারপাশে ঝুলতে থাকে বিচিত্র বিষয়আশয়, কোথাও ভাঙাচোরা জানালা মুখব্যাদান করে থাকে, তা হলে দৃষ্টি হোঁচট খাবেই। বছরের পর বছর ধরে এখানে বেশ ক’টি বহুতল ভবনের কাঠামো দৃশ্যমান। দিনে দিনে তা কংকালসদৃশ চেহারা পেয়েছে। রাস্তা খুঁড়ে তোলা ভগ্নাংশ আর সিমেন্টের চৌকোনা নির্মাণসামগ্রী এবড়োথেবড়োভাবে পুরো সড়ক বরাবর রেখে দেয়া, যেন পরিত্যক্ত নগরীর পথ। সেসবের অংশবিশেষ আবার ফুটপাথে উপচে পড়েছে। খুঁটি থেকে অজস্র ঝুলন্ত তার বড়ই দৃষ্টিকটু। ফার্মগেটের মোড়ে চোখ পড়বেই এমন মোক্ষম স্থানে তিনটে পাশাপাশি চারতলা ভবনের শুধু নিচতলার নির্মাণ সম্পন্ন করে মিনি মার্কেটের রূপ দেয়া হয়েছে। ওপরে কেবল স্তম্ভ আর ছাদ। বিকট বিসদৃশ বিশ্রি সেই রূপ। প্রধান সড়কের পাশে জমির মালিক হলেই কি আমি সেই জমিতে অসমাপ্ত ভবন রেখে দেবো দু-পাঁচ বছর? আবার প্রাচীর ঘেরা যেসব সংস্থার কার্যালয় রয়েছে সেগুলোর প্রাচীর-দেয়াল হয়ে উঠেছে রুচিহীনতা ও দারিদ্র্যের চূড়ান্ত নমুনা। ভাঙাচোরা ফুটপাথ, তার কোল-ঘেঁষা নালার চারপাশ কোথাও হয়ে উঠেছে ভাগাড়খানা, কোথাও বা পরিত্যক্ত কসাইখানা। বাস-যাত্রীদের ওঠানামার মূল জায়গায় এবং গোটা সড়ক জুড়ে দক্ষিণমুখী বাস-মিনিবাস সুযোগ পেলেই জটলা পাকায়, সেই জট গলিয়ে কোন এ্যাম্বুলেন্স কি প্রাইভেট কার যাবেÑ তার জো থাকে না। হর্নের উচ্চ শব্দ আর বাসে যাত্রী তোলার জন্য হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি দুই কানে হাতুড়িপেটা করতে থাকে। রীতিমতো নরক গুলজার! ফার্মগেট এলাকার এই রুগ্নদশা ভগ্নদশা এক লহমায় রাজধানীর মানসম্মান ধুলায় লুটিয়ে দেয়। মহানগরীর একটি প্রধান সড়কের আশপাশের চেহারায় থাকবে আধুনিকতা পরিচ্ছন্নতা সুরুচির প্রকাশ। সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানো হবে এটাই প্রত্যাশিত। সুপরিকল্পনা থাকতে হবে। আমরা অনুরোধ করব যথাযথ কর্তৃপক্ষ এখানকার শুধু পাঁচশ’ গজ এলাকাকে অসুস্থ দশা থেকে মুক্তি দানের জন্য এলাকাটি পরিদর্শন করুন। হয়তো ছয় মাসে তার চেহারায় পরিবর্তন আসবে না। না আসুক, এক বছর লাগুক, দরকার হলে আরও ছয় মাস অতিরিক্ত লাগুক, তবু তার পাগল-পাগল দুর্দশা কেটে যাক। দেখে যেন কারও মনে না হয় যে এলাকাটায় অতিসম্প্রতি ভূমিকম্প হয়ে গেছে। অতিরিক্ত গাড়ির বহর! ঢাকা নিয়ে এমন সব তথ্য হঠাৎ হঠাৎ আমরা পাই যা আমাদের বিমূঢ় করে দেয়। বলা যায় আমাদের চোখ খুলে দিতে সাহায্য করে এসব তথ্য। পৌনে দুই কোটি মানুষের এই শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর কথা বলেছি আমরা। কত আর বলা যায়। ঢাকার ৯৪ শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়ির সুবিধা ভোগ করেন মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ। অথচ ৭৬ শতাংশ সড়কই তাদের গাড়ির দখলে থাকে। রাস্তা কম আর প্রাইভেট কার বেশি এমন পরিস্থিতিতে এটাই তো হবে। দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি যে জায়গা নেয়, একটি মিনিবাসও একই পরিমাণ জায়গা দখল করে। অথচ একটিতে আরোহণ করেন দুই থেকে ছয়জন, আর মিনিবাসে অর্ধশত যাত্রী। সড়ককে গতিশীল ও যানজটমুক্ত করতে গণপরিবহন সহজলভ্য করে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজনÑ এমন অভিমত এসেছে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘যানজটমুক্ত ঢাকার রূপরেখা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে। তাতে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছেÑ মানসম্মত গণপরিবহন বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পৃথক লেন নির্ধারণ, আধুনিক রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা, জলপথ ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। এর একটি কথাও কি নতুন? না, নতুন নয়। তবে উপস্থাপনা ও দৃষ্টি আকর্ষণের বিশেষ কৌশল রয়েছে। অনেক আগে একবার ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উঠেছিল। ওই পর্যন্তই। কোনো পরিবারে পাঁচটি গাড়ি রয়েছে, তাকে কিভাবে বাধ্য করা হবে মাত্র দুটি গাড়ি দিয়ে প্রয়োজন মেটানোর? এটি কি সমীচীন হবে? এই তো সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক গভর্নর বললেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫ হাজার ব্যক্তি কোটিপতি হচ্ছেন। কোটিপতির ব্যক্তিগত গাড়ি থাকবে না? গাড়ি কেনার জন্য ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে থাকে মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীদের। অন্য পেশার লোকদের কথা নাই বা বললাম, সাংবাদিকতা পেশাতেই বহুজন আছেন যাদের বেতনের অর্ধেকের বেশি চলে যায় শুধু গাড়ি পুষতে। নিশ্চয়ই তাদের ভিন্ন পথ রয়েছে উপার্জনের। কথা সেটা নয়। গাড়ির অনিবার্যতা ও গাড়ি হাঁকানোর সংস্কৃতি নিয়েই আলোকপাত। সেইসঙ্গে গণপরিবহনের যথাযথ বহর ও শৃঙ্খলার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একটি শহরে লোকসংখ্যা কত, সড়কের আয়তন কতÑ এসব বিষয় বিবেচনা করেই সড়কে গাড়ি নামানোর পরিকল্পনা করতে হয়, সেভাবেই গাড়ির মালিককে অনুমতি দেয়া হয়। ঢাকার যে দশা তাতে প্রত্যেকটা রাস্তা দোতলা-তিনতলা করে দিলেও গাড়ির ঠোকাঠুকি দূর হবে না। এর সমাধান কি? রাজধানীর ‘শরত-বসত’ কাশবনে ছুটন্ত ট্রেনের ছবি আমাদের চোখে লেগে আছে সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে; সেখানে অপু দুর্গার যুগল বিস্ময় আমাদের হৃদয়ে চির জাগরূক। কাশবন কন্যাদের ফটোসেশন আমরা দেখতে পাচ্ছি অধুনা ফেসবুকের সৌজন্যে। রাজধানীর ট্রেডমার্ক কাশবন হলো দুটি: দিয়াবাড়ি ও বসুন্ধরার ৩০০ ফুট রাস্তার পাশের প্রান্তর। লালমাটিয়া থেকে উত্তরা আসার পথে বাদামী ঘোড়া দেখে গাড়ি থামিয়েছিলেন এক নিকট আত্মীয়া। দেখে মনেই হবে না এটি ঢাকার একটি অংশ- যেন যুক্তরাজ্যের দৃশ্য। ঘোড়া নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের অবসেশন কম ছিল না। তার কত কবিতাই না উঠে এসেছে বিচিত্র মাত্রিকতায়। ডানাওয়ালা ঘোড়ার পদশব্দ শুনেছি কত! দিয়াবাড়ির ঘোড়াটি দেখলে নিশ্চয়ই কবির কলম নিশ্চল থাকত না। বসুন্ধরার ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দলেবলে ঢাকাবাসী চলেছেন শারদীয় মাধুর্য উপভোগে। এসব দৃশ্যের কথা আমি শুনেছি। শুধু নারীরাই ছিলেন, গৃহিণী কর্মজীবী মুক্তনারী। এদের সবারই কৈশোরে যে কাশফুল স্বপ্ন জাগিয়েছে, এমন নয়। তবে কাশফুলের এই অবারিত নন্দিত তাদের আকর্ষণ করেছে। আহ্বান জানিয়েছে নির্মল আনন্দ অবগাহনে। আমাদের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, বহমান যে আনন্দধারার মধ্যে আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ করি তার ঐশ্বর্য ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না। যখন তার প্রভাব ঘটে তখনই কেবল হাসফাঁস করে উঠি। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এই যে আমরা ছয়-ছটি ঋতুর পৃথক সৌন্দর্য আস্বাদন এবং তার মহিমা উপভোগের সৌভাগ্য দৈশিক সূত্রে পেয়ে গেছি- তার মূল্য কি যথাযথভাবে অনুভব করে থাকি? মহানগরী ঢাকায় গ্রামীণ শরতের আমেজ ও আবেশ চান? যেতে পারেন উত্তরার দিয়াবাড়ি। বুঝেছি শহরের খুব গভীরে থাকে পল্লী, যেখানে শরতের চুম্বন অনুভব করা যায় পুরোদমে। শারদসন্ধ্যায় দিয়াবাড়ির কাশবনে হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ যান্ত্রিক শব্দে চমকে ওঠে মানুষ; আকাশ বন পেরিয়ে উড়ে আসছে বিমান। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে অবতরণ করবে রাজধানীর মাটিতে। দিয়াবাড়ির অবারিত অঙ্গনের সৌন্দর্যে নিমজ্জিত হয়ে ভেসে চলুন মেঘে আর আকাশের ওপারে আকাশ থেকে মেঘের পরে মেঘ পেরিয়ে দেশের মানুষকে তার দেশের মাটিতে নিয়ে আসার আগমনী আওয়াজে আরেকবার নেমে আসুন কাশফুলের ঠিক পাশটিতে। সত্যি বলছি, এই শরতে একবার দিয়াবাড়ি বেড়িয়ে আসুন- আমার মতোই দিয়ারবাড়ির নাম বদলে রাখবেন- ‘শরত-বসত’। রাস্তায় নাস্তানাবুদ রবিবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে যারা মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে কর্মস্থলে গেছেন সেইসব ভুক্তভোগী জানেন বিষয়টা। সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত তিন যানবাহনের কারণে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে কর্মব্যস্ত মানুষের। সালমা লুনার পোস্ট তুলে দিচ্ছি। তিনি লিখেছেন : ‘মাঝরাতে মানিকমিয়া এভিনিউতে একটা বাস আর লরি সংঘর্ষ হলো। বাসটি একটি সিএনজির ওপর পড়ে সিএনজিটি চ্যাপ্টা হয়ে গেল। এবং তিনটি যান ওই ব্যস্ত রাস্তায় পড়ে রইল বাকিটা সময়, এমনকি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত! রবিবারের কর্মব্যস্ত সকালে এরকম একটি রাস্তা বন্ধ থাকলে কি হাল হতে পারে তা আমরা অনুমান করতে পারলেও কর্তৃপক্ষ সম্ভবত পারেন না। তাই সামান্য কটি যান সরাতেই কয়েকঘণ্টা দেরি হলো! (টিভিতে সকাল সাড়ে দশটার খবরে দেখেছি আহত হলেও কেউ মারা যায়নি)’ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ [email protected]
×