ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউপি নির্বাচনের জেরে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ নেতা নিহত

চার মাস এলাকা ছাড়া দুই শ’ পরিবার

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চার মাস এলাকা ছাড়া দুই শ’ পরিবার

রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল থেকে ॥ কালিয়া উপজেলার পেড়লী গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকা-ের ঘটনায় চার মাস ধরে বাড়ি ছাড়া ২০০ পরিবার। শুধু বাড়ি ছাড়া নয়; প্রতিপক্ষের লোকজন এসব পরিবারের বসতঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘর, গোয়ালঘর ভেঙ্গেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে এসব পরিবারের বিছানাসহ আসবাবপত্র। ভয় ও আতঙ্কে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় যেতে পারছে না বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা। বন্ধ রয়েছে লেখাপড়া। কোন কোন পরিবারের শিশু ও নারীরা দিনের বেলা বাড়িতে এলেও রাতের বেলা থাকতে পারছেন না। পেড়লী গ্রামের ২০০ পরিবার ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহার আনন্দ-উৎসব থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এসব অভিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের। সরেজমিনে ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতেও পেড়লী গ্রামের মিঠু শিকদারের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তালা ও গ্রিল ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে রঙিন টেলিভিশন, বক্স খাট, কম্বল, হাঁড়ি-পাতিল, গ্যাসের চুলা, স্বর্ণের কানের দুল, গলার হার, আংটিসহ প্রায় আড়াই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মিঠু শিকদারের আত্মীয়স্বজনেরা। ভয় ও আতঙ্কে মিঠু শিকদারের পরিবারের সদস্যরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। তবুও তাদের ঘরের গ্রিল কেটে মোফাজ্জেল গ্রুপের লোকজন লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া গত চার মাসে অন্তত ৭০টি বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে। জানা যায়, ইউনিয়ন নির্বাচন (ইউপি) পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২৫ মে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে কালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পেড়লী গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেন (৫০) নিহত হন। এর আগে ২৩ মে পেড়লী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিহত মোফাজ্জেল হোসেন চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী জারজিদ মোল্যার সমর্থক ছিলেন। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন ইকবাল পরাজিত হন। মোফাজ্জেল হত্যাকা-ের পর পেড়লী গ্রামে প্রতিপক্ষের অন্তত ৭০টি বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাকা দালান ঘর ও টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বিধ্বস্ত ঘর এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া দেড় হাজার মণ ধানসহ বিভিন্ন ফসল, ২০০ গরু লুটপাট এবং শিক্ষার্থীদের বইখাতাসহ শিক্ষা উপকরণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদ খোয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পেড়লী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বাবুসহ ক্ষতিগ্রস্তরা। ঘটনার চার মাস পর শনিবার বিকেলে পেড়লী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এত দিনেও স্বাভাবিক হতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্তরা। ফিরতে পারছেন না বাড়িতেও। বিশেষ করে পুরুষেরা বাড়ি ছাড়া। পেড়লী গ্রামের কিবরিয়া মোল্যার স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, বাড়িঘর ভেঙ্গেচুরে ও কেটে ফেলেছে প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষের ভয় ও আতঙ্কে একদ- কেউ বাড়িতে দাঁড়াতে পারে না। আমরা চার মাস ধরে বাড়ি ছাড়া। সাংবাদিকদের আগমনের বিষয়টি জানতে পেরে বাড়িতে এসেছি। আপনারা (সাংবাদিক) চলে গেলে, আবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে। জেসমিন খানম বলেন, আমার এক ছেলে কলেজে (এইচএসসি) এবং আরেক ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু, প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার ভয়ে চার মাস ধরে স্কুল, কলেজে যেতে পারছে না আমার দুই ছেলে। পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে তাদের। রেজাউল মোল্যার স্ত্রী হেমেলা জানান, তার ছেলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু বাড়িঘরে থাকতে না পারায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সংশয় রয়েছে। প্রতিপক্ষের ভয়ে তার স্বামী ও ছেলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া তাদের পরিবারের ধানসহ সব লুট করে নিয়ে গেছে মোফাজ্জেল সমর্থকরা। এদিকে, পেড়লী এলাকার বিপুল সংখ্যক লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করায় পেড়লী বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভাটা পড়েছে। অনেকে প্রতিপক্ষের ভয়ে বিভিন্ন দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছেন না। এলাকার সাধারণ লোকজনও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছেন না। পেড়লী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যা দাবি করে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পেড়লী গ্রামে দুইপক্ষের সংঘর্ষে মোফাজ্জেল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের কোথাও কোন বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে। পেড়লী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এটিএম তসরিফুজ্জামান দাবি করে বলেন, হত্যাকা-ের পর যেসব বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়েছিল, সেই অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে কোন বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট হয়নি। এছাড়া আসামিরা জামিনে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
×