ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেষকৃত্য সম্পন্ন

দ্বিজেন শর্মাকে ফুলে ফুলে বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দ্বিজেন শর্মাকে ফুলে ফুলে বিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রকৃতিকে ভালবেসেছিলেন দ্বিজেন শর্মা। তাই তো বৃক্ষরাজি, ফুল আর তরুলতার সমারোহ গড়তে চেয়েছিলেন শহর ঢাকাসহ দেশজুড়ে। বিদায়বেলায় সেই প্রকৃতিরই সুন্দরতম অনুষঙ্গ ফুলে ফুলে আবৃত হলো এই নিসর্গবিদের শবদেহ। প্রকৃতিপ্রেমী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, নাট্যজন, কথাসাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদসহ সর্বসাধারণের পুষ্পাঞ্জলিতে সিক্ত হলো তার শেষ যাত্রা। প্রকৃতির প্রতি এই নিসর্গসখার মমত্বের প্রাপ্তি হিসেবে পেলেন আপামর মানুষের ফুলে ফুলে ভালবাসা। কয়েক দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে শায়িত হলেন চিরনিদ্রায়। রবিবার সকালে স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘর থেকে দ্বিজেন শর্মার শবদেহ নিয়ে আসা হয় বাংলা একাডেমিতে। এখানেই তাকে নিবেদন করা হয় প্রথম দফার শ্রদ্ধাঞ্জলি। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ভাষাশহীদদের স্মৃতির স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে এই প্রকৃতিবিদকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ। নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান পর্ব শেষে নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল নটর ডেম কলেজ আঙ্গিনায়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে তারই পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় প্রাঙ্গণটি পেয়েছে সবুজে-শ্যামল রূপ। সেখানে তাকে নিবেদন করা হয় তৃতীয় দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে রাজধানীর সবুজবাগের রাজারবাগ বরদেশ্বরী কালি মন্দিরসংলগ্ন শ্মশানে সম্পন্ন হয় তার শেষকৃত্য। দ্বিজেন শর্মার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরবর্তীতে নিসর্গসখার চিতাভস্ম সমাধিস্থ করা হবে মৌলভীবাজারের বড়লেখার কাঠালতলী গ্রামে। বেলা সোয়া ১১টায় বাংলা একাডেমিতে এসে পৌঁছে দ্বিজেন শর্মার শবদেহবাহী ফ্রিজার ভ্যান। এখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কথাসাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, প্রাবন্ধিক রমণীমোহন দেবনাথ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ইনাম আল হক, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলামসহ অনেকে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানান, বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা বের করবে। এরপর তার স্মরণে স্মারকগ্রন্থ ও জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। তিনি বলেন, প্রকৃতিবিদ হিসেবে দ্বিজেন শর্মার পর আর কাউকে সে জায়গায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। তেমন বড় কেউ উঠে আসছেন না। তিনি আমৃত্যু ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলে গেছেন। বৃক্ষরাজির অভাবে আর কংক্রিটের চাপে ঢাকা শহর বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে যাবে-এটা তিনি মানতে চাইতেন না। দ্বিজেন শর্মার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথা উঠে আসে এই শিক্ষাবিদ ও শিশুসাহিত্যিকের কথায়। বলেন, আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ৫০ বছরের পুরনো। আমি সাহিত্যের লোক, দ্বিজেন দা বিজ্ঞানের। কিন্তু কী অসাধারণ গদ্য লিখতেন! কখনও বাংলা লিখতে গেলে খুঁটিনাটি জানতে হলে আমার সাহায্য নিতেন। এত বড় মাপের মানুষ, অথচ তাকে কোনদিন অহঙ্কার করতে দেখিনি। রামেন্দু মজুমদার বলেন, দ্বিজেন দা কর্মসূত্রে যেখানে গেছেন, সেখানেই তিনি গাছে গাছে ভরিয়ে দিয়েছেন। বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে গাছ চেনাতে এবং বৃক্ষের প্রতি মমত্ব বাড়াতেও তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তবে এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নয়, নীরবে-নিভৃতে আপন কাজটি করে গেছেন। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, তার পরিপূর্ণ বয়স হওয়া সত্ত্বেও আজ মনে হচ্ছে, তিনি যেন আমাদের অকালে ছেড়ে চলে গেলেন। এই মানুষটি আমাদের বৃক্ষকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন, জীবনের সঙ্গে গাছের ছন্দকে জানিয়েছিলেন, বৃক্ষরাজির সঙ্গে মানবিক প্রেমের সুর শিখিয়েছেন। তার মতো মানুষ এ সমাজে আর নেই। তার অভাব দীর্ঘদিন আমাদের পীড়া দেবে। যতদিন বাংলাদেশের মাটিতে গাছ থাকবে, বৃক্ষরাজি সূর্যের দিকে তাকাবে, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। শহীদ মিনার পর্ব ॥ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেদীর উল্টো পাশের গগন শিরীষ বৃক্ষতলে রাখা হয় নিসর্গসখার শবদেহ। এ পর্বের সূচনায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগ। দলের পক্ষে দলের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এছাড়া শহীদ মিনারে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নাট্যজন মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মুকিত মজুমদার বাবু। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় ছায়ানট, এশিয়াটিক সোসাইটি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ, ছাত্র ফেডারেশন, রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, অনুসন্ধিৎসু চক্র, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতি, নেচার স্টাডি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঘুড়ি ফেডারেশন, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকের স্মৃতির্পণ করতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ জানান, ১৯৬০ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে দ্বিজেন শর্মার সরাসরি ছাত্র ছিলেন তিনি। সেই শিক্ষকতার মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, প্রথিতযশা এক শিক্ষক ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। তিনি ক্লাসে যা পড়াতেন, তা আর দ্বিতীয়বার পড়তে হতো না। আমার প্রিয় শিক্ষক দ্বিজেন শর্মা একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করলেও নীরবে-নিভৃতে অজস্র গবেষণা করে গেছেন। সেই গবেষণাধর্মী কাজগুলোর সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমেই তার প্রতি সঠিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, রাজপথে না থাকলেও লেখনী ও কথায় তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলে গেছেন, যে সমাজতন্ত্র পথ দেখায় মানব মুক্তির। আজীবন এক প্রগতিশীল চেতনার মানুষ ছিলেন তিনি। প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক বলেন, নিসর্গবিদ, মানবতাবাদী মানুষটির এক অদ্ভুত জীবনদর্শন ছিল, সে জীবনদর্শন ছিল মানুষকে বড় করে দেখার। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সামঞ্জস্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখতেন, মানুষ এসবে মোটেই দৃষ্টিপাত করে না। এসব বলে তিনি বড় বেদনাহত হতেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার লেখা আর রোপণ করা গাছগুলো তার হয়ে কথা বলবে। পরিবারের পক্ষে ছেলে সুমিত্র শর্মা বলেন, বাবা দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন, হয়তো সব ভাষা জানতেন না। কিন্তু তিনি সব মানুষকে বড় আপন করে নিতে পারতেন। তিনি যেমন প্রকৃতিকে ভালবেসেছিলেন, আজ মনে হলো প্রকৃতির যেন তার সেই ভালবাসার প্রতিদান দিল। সকালে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া দেখে শঙ্কা জেগেছিলে যে, বাবার শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে হয়তো বিঘ্ন ঘটবে। কিন্তু প্রকৃতি সেই শঙ্কা ঘুচিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক করে বাবার শেষযাত্রা সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করল। মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা তার বাবার কাজগুলোকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাবার আদর্শকে যদি আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিয়ে যাই, তবেই বাবার প্রতি সঠিক সম্মান জানানো হবে। শুক্রবার ভোর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দ্বিজেন শর্মা। কিডনি ও ফুসফুসজনিত জটিলতাসহ মাল্টিপল অর্গান অকার্যকর হয়ে তিনি মারা যান।
×