ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনি মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালবাসিলাম?

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালবাসিলাম?

এখন রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ। অথচ বিশ্বের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বিশ্ব তো দূরঅস্ত। প্রতিবেশী দেশ ভারত চীন এমনকি রাশিয়ার কণ্ঠে ও ভিন্ন সুর। মিয়ানমার কি আসলে এত শক্তিধর? না এই খেদানোর পেছনে আছে আর কোন নতুন চাল? একটা বিষয় মাথায় ঢোকে না কখন থেকে আমরা এত বাচাল আর সবজান্তা জাতিতে পরিণত হলাম? যে যা পারছে তাই বলছে, লিখছেও। কেউ কেউ দেখি এ নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ টেনে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এগুলো সস্তা বিষয়। খালেদা জিয়া বললে কি আর না বললেই বা কি। আমাদের দরকার সম্মিলত প্রতিরোধ আর বিষয়টির সুরাহা। মূলত এখন এটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। আপনি যদি ভাল করে ভেবে দেখেন এই সমস্যার আঁচ সহজে নিভবে না। কোথায় রাখব আমরা এই অসহায় মানুষগুলোকে? ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক কূটচাল। এদের নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে কাদা মাখবে এটাও নিশ্চিত। কিন্তু মনে রাখা দরকার এই রোহিঙ্গারা নেতৃত্বহীন বলতে গেলে মেধাহীন একটি জাতি। যারা দীর্ঘকাল ধরে মিয়ানমারে নিষ্পেষিত। কিছুটা তারাও দায়ী। এখন সে সব ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন কিভাবে তাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব আর কেন এই পুশ বা ঠেলে পাঠানো? জানি সবাই জানার পর ও এ বিষয় কোন দিন আলোর মুখ দেখবে না। যেমন দেখেনি দুনিয়ার অনেক জটিল বিষয়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই কি দুনিয়া? সব ঘটনাই কি এক সময় চাপা পড়ে যাবে? দুনিয়া কি কোনদিন ও সত্য জানবে না? জানার অধিকার থাকবে না মানুষের? সে কবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল সেই নৃশংসতার কাহিনী এখনও রহস্যঘেরা। কে মেরেছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে? কারা মারল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কে? কেন বিচার হলো না গান্ধী হত্যার? এসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি আজও। এ লেখা লিখছি, এই বিশ্বের দৃশ্যপট বদলে যাওয়া একটি ঘটনার দিনে। নাইন ইলেভেন নামে পরিচিত এই দিনে আমেরিকায় ঘটেছিল এক অস্বাভাবিক ঘটনা। ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব জাতি সব দেশের মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল এক অভিনব দুর্ঘটনায়। এর আগে মানুষ কোনদিন ভাবতে পারেনি উড়োজাহাজ হতে পারে হাতিয়ার। তাকে দিয়ে কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। সে ভয়াবহ ঘটনায় বদলে যাওয়া বিশ্বকে আজো আমরা আগের জায়গায় দেখতে পাইনি। আর কোনদিন তা হবে বলেও মনে হয়না। এসব ঘটনার মাজেজা বোঝা আমাদের মত আম জনতার কাছে দুর্বোধ্য। তবে আমরা এটুকু বুঝি দুনিয়া আর আগের দুনিয়া নাই। একটা বিষয় মানতেই হবে এই ঘটনার জের আর মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতায় মৃত্যু এখন অতি সাধারণ কোন ঘটনা। আগে অল্প মানুষের প্রাণহানিতেই টনক নড়ত সভ্যতার। সে মানবিক বোধ প্রায় লুপ্ত। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রতিদিন প্রতি মিনিটে যদি একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে মানুষ তো ভুলে থাকতেই চাইবে। কে না জানে মানুষ মূলত জীবনমুখী। তার আশা তার ভরসাই তাকে বঁাঁচিয়ে রাখে। মরণেরে তুঁহু মম শ্যাম সমান বলে কবিতা লিখলেও রবীন্দ্রনাথ আসলে মরতে চাননি। চাননি বলেই আশি বছর বেঁচেছিলেন। আজকের দুনিয়ায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিলে মানুষ কোনটাই নির্ধারণ করে না। এমনকি তার জীবনও নয়। আমরা এখন আমাদের বাংলাদেশে মানুষের যে মিছিল যে স্র্রোত দেখছি তার পেছনেও আছে মরণের হাতছানি। পাশের দেশ মিয়ানমারে রাজনৈতিক ঝামেলায় একটি সম্প্রদায় কিংবা জাতিগোষ্ঠী প্রায় মুছে যাওয়ার পথে। রোহিঙ্গা নামের এই মানুষগুলোর জীবনে আজ যে আপদ আজ যে বিপদ তার দায় কারও একার হতে পারে না। মিয়ানমার যে ধোয়া তুলসীপাতা তা নয়। আবার অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের ও হয়ত আছে উস্কানির দায়। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? কোন কথা কোন যুক্তি কোন আলোচনা বা সমঝোতার বাইরে তাদের এভাবে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া কি সভ্যতা? আজ আর কোন প্রতিষ্ঠান কোন সংস্থা কোন মানুষ একক না। কেউ কারও কথা শোনে না। একটা সময় ছিল যখন জাতিসংঘ মানেই ভরসা। কি কারণে এর প্রতিষ্ঠা? আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো তখন অভিভাবকের ভূমিকায়। তাদের ধারে কাছে ঘেঁষার সাধ্য ছিল না কারও। তারাই তখন আলোক বর্তিকা। যদিও এশিয়া বা লাতিন আমেরিকার সভ্যতা তাদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন তার পরও এরাই চালাতেন দুনিয়া। ততদিন সব ঠিক। জাতিসংঘও ঠিক। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো উঠে আসল যখন তাদের মুখে কথা ফুটল, যখন চীন বড় হয়ে উঠল তখন শুরু হল দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। সবাই যখন তাদের কথা বলতে শুরু করল আঁতে ঘা লাগল মুরব্বিদের। তারা তখন থেকে জাতিসংঘকে অকার্যকর করার চেষ্টায় মন দিয়েছিল। একবার ভাবুন রাশিয়া না থাকলে আমরা কোনদিন কি পাকিস্তান আমেরিকার চাপমুক্ত হয়ে মাথা তুলতে পারতাম? সেই জাতিসংঘে এখন ভারত ব্রাজিলসহ অনেক দেশ তাদের মাথা তুলছে। ফলে আমেরিকা ও মুরব্বি নামে পরিচিতদের গাত্রদাহ স্বাভাবিক। এখন তাই সে পুতুল। কোনদিন তার দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বের নানা দেশে এখন যে উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা সেটা মুরব্বিদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছে। আগের মতো দান খয়রাত করে দেশ দখল বা সমাজে প্রভাব বিস্তার করা যায় না। তাছাড়া এখন সামাজিক মিডিয়ার স্বর্ণযুগ। কেউ কাউকে বেশি দিন অন্ধকার বা মিথ্যায় রাখতে পারে না। আগে আমরা অনেক কিছুই বুঝতাম না। আমেরিকায় যে বন্যা হব আর সে ঝড়ের সামাল দিতে তারা যে হিমশিম খায় সেটা এখন সবাই জানে। এসব কাজে কিউবা যে তাদের চেয়ে এগিয়ে সেটাও জানে সবাই। আমেরিকা বলে নয় দুনিয়ার সব দেশের চাইতে মেধা ও প্রজ্ঞায় এশিয়ার বহু দেশ যে এগিয়ে সেটাও আজ অজানা কিছু না। ফলে আমাদের মানতে হবে অনেক ঘটনা ঘটবে যার মূল কাহিনী কোনদিন জানা যাবে না। তবে যে কাহিনী আমাদের জীবনকে নাড়িয়ে দেয় আমাদের ভ্রমণ মানুষের চলমানতাকে থামিয়ে দেয় তা জানার অধিকার সকলের আছে বৈকি। সভ্যতার আরেকদিকে থাকা জঙ্গীদের টার্গেট করা ভদ্র দুনিয়া কেন সব খুলে বলে না? যখন তারা ইরাকে গেল আমাদের বলা হলো সেখানে গণতন্ত্র আসবে। সাদ্দাম হোসেনের আমলে মানুষ বাজারে যেত, অফিসে যেত, বাচ্চারা স্কুলে যেত, আর এখন? তাদের ভাষায় একনায়ক নেই কিন্তু ইরাক আর আগের ইরাক ও নেই। যে ভয়াবহ বাস্তবতা তার নাম কি গণতন্ত্র না মৃত্যুপুরী? এরপর দেখলাম লিবিয়ার ভয়াবহতা। আর আফগানিস্তান তো এখনও সেই আগের জায়গায়। কাবুলে মানুষ না সেনারা বসবাস করে, না বহুজাতিক অস্ত্রের বাজার এ নিয়ে এখন গবেষণা হতে পারে। এই যে এত এত কথা এর উদ্দেশ্য একটাই আমরা বুঝতে চাই আসলে শান্তি কোথায়? আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশের মানুষরা ভাল থেকে এশিয়া বা অন্য দেশে হানাহানি বজায় রাখলে কি আসলে দুনিয়া ভাল থাকবে? মাঝখান থেকে মানুষের জীবন হয়ে গেছে উইপোকার মতো। তাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করছে আজকের সভ্যতা। এখন আমরা যা শুনি যা দেখি যা বলি তার বেশিরভাগই কল্পনাপ্রসূত। মিডিয়ার নামে আজকের দুনিয়া হয় একপেশে নয়ত বিকৃত। এক ঘটনা এক কাহিনী মিডিয়া ভেদে একেক ধরনের বর্ণনা। বিবিসি যা বলে সিএনএন তা বলে না আলজাজিরা যা দেখায় এশিয়ার টিভি তাকে মানে না। এসব মিলিয়ে এমন এক জগত যখন আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার মতো জ্বলন্ত সমস্যাকেও আসলেও বুঝতে পারি না। এমন সব ছবি দেখছি যেগুলো আসলে সে এলাকার মানুষের ছবি না। আবার এমন সব বিষয় উহ্য থেকে যাচ্ছে যাতে ভয়াবহতা চাপা পড়ে যায়। এর নাম আধুনিকতা? এর নাম স্বচ্ছতা? সে কারণে আমাদের জীবদ্দশায় নাইন ইলেভেন তো দূরের কথা আমাদের দেশের ওয়ান ইলেভেনের জটও কোনদিন খুলবে বলে মনে হয় না। আমরা স্পেকুলেশন বা কল্পনা বাস্তবতা মিলিয়ে দেশ ও সমাজ ভেদে অন্ধকারেই থেকে যাব। একদল বলবে জঙ্গীরা দায়ী আরেক দল বলবে ষড়যন্ত্র। আসল ষড়যন্ত্র মূলত মানুষের বিবেকে। মানুষ যখন থেকে তথ্য বাস্তবতা আর কৌশলে পারদর্শী হয়ে উঠেছে তখন থেকে মিথ্যা বা গোপনীয়তাও তাকে ছেঁকে ধরেছে। কোনকালে কোন সুবর্ণ সময়ে কোন মহাকালে হয়ত কোন নতুন জেনারেশনের হাতে উন্মোচিত হবে সকল সত্য। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপের আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের এটাই শেষ ভরসা। আপাতত গড়ে হরিবোল বা যা শুনি তাকে ঘিরেই চলার নাম জীবন। রোহিঙ্গা সমস্যা একসময় যে আকার ধারণ করুক আমরা কি কোনদিন জানব আসলে এর আড়ালে কোন্ খেলা? এই মানুষগুলোর পরিণতির পেছনে কি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আর তার নেতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কি কোন চক্রান্ত কাজ করছে? আছে কি পরাশক্তির ইন্ধন? ইতিহাস শুধু না, সময়ের কারণে এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে আমাদের মোড়লরা যেমন জানবে না আমরাও নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারব না।
×