ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আঁধি চোখকে করে না অন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আঁধি চোখকে করে না অন্ধ

চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বৈলতলি গ্রামের মুহম্মদ সবুর স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তিনি তার মাতামহ ও মাতৃ সহোদরের দেখা পাবেন। বাণিজ্যিক কারণে তার পিতামহ এবং পিতা রেঙ্গুনে চলে যান চট্টগ্রাম ছেড়ে ব্রিটিশ শাসন যুগে। সেখানেই তার পিতা বিয়ে থা করেন বর্মী নারীকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য সব ফেলে এক বস্ত্রে চলে আসেন চট্টগ্রামে। মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনতেন বার্মার। সেখানকার জনজীবনসহ নানা বিষয়ে তার একটা ধারণা জন্মায়। খুব সাধ জাগে মামার বাড়ি যাওয়ার। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। অবশেষে রেঙ্গুন যাবার সুযোগ হলো, যখন আমলা হিসেবে পেঁয়াজ কেনার জন্য দেনদরবার করতে গেলেন সে দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে। মামার বাড়ি খুঁজে না পেলেও পেয়েছেন চট্টগ্রাম বংশোদ্ভূত কয়েকজনকে। যারা চাটগাঁর উপভাষা জানেন পরম্পরায়। তারা সেখানে ভালই আছেন জেনে স্বস্তি পেয়েছিলেন। মামাতো ভাই-বেরাদারের সঙ্গে তার যে ইহজীবনে আর যোগাযোগ হবে না, তা তিনি বুঝতে পেরেছেন রেঙ্গুনে সপ্তাহখানেক অবস্থানকালে। রেঙ্গুন থেকে আকিয়ার ও রাখাইন রাজ্যে যাবার ইচ্ছে তার দমিয়ে দিলেন মিয়ানমারের সরকারী কর্মকর্তারা। সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে মংডু পর্যন্ত যেতে হলে, তাকে বাংলাদেশে ফিরে টেকনাফ সীমান্ত হয়ে যেতে হবে। এত কড়া বিধিনিষেধ হতবাক করেছে যুদ্ধ জয়ে স্বাধীন দেশের আমলা মুহম্মদ সবুরকে। বাড়িতে বেশকিছু পুরনো পুঁথি পেয়েছিলেন। সেসব নাড়াচাড়া করে খুঁজে পেয়েছিলেন চাটগাঁর পুরুষ আর আরাকানী নারীর প্রেমের কাহিনী। মিলনে নয়, বিচ্ছেদে শেষ হয়েছে পুঁথির কাহিনী। বার্মা বা মিয়ানমার ঘরের পাশে হলেও তার মনে হতো, কতদূরের দেশ। কঠিন অর্গলে আবদ্ধ দেশটি তাকে ভাবাত। সেদেশের সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গা খেদাও শুরু করে, আর অনুপ্রবেশকারীরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে চলে আসে টেকনাফে তখন তিনি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গী-সাথী নিয়ে। এ এক অন্য ধরনের টান। অন্যরকম বোধ। রোহিঙ্গাদের অনেকে চন্দনাইশের ধোপাছড়ি পাহাড় এলাকায় বসবাস শুরু করে। এদের কেউ কেউ তার পিতৃপুরুষের জমিজমা দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত হয়। সস্তা শ্রম, চাহিদাও কম, তবুও রোহিঙ্গারা ফলন ফলায় গভীর মগ্নতায়। কিন্তু তাদের কণ্ঠে কখনও কোনদিন শুনেননি গুনগুন করে গান গাইতে। জাগতিক কোন বিষয় তাদের কাছে খুব প্রাধান্য পেত না। দুবেলা দুমুঠোতেই সন্তুষ্ট তারা। এদের বংশ ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। একপর্যায়ে তাদের নামে জমিও বরাদ্দ করেছেন পিতা। সেসব রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে, জন্মভূমে, পিতৃভূমে ফিরে যাবার কথা আর ভাবতেন না। রাষ্ট্র কর্তৃক নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত এবং শিক্ষা-দীক্ষাহীন রোহিঙ্গাদের জীবনে সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সন্তান উৎপাদন ছাড়া আর কোন সুখপ্রদ ঘটনা তাদের জীবনে সমাগত হতে দেখেননি। অবসরপ্রাপ্ত আমলা মুহম্মদ সবুর এখনও স্বপ্ন দেখেন তার মামাবাড়ির। ভাবেন, একদিন ঠিকই যাবেন এবং খুঁজে পাবেন। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার শিকার হবার ঘটনা তাকে স্তম্ভিত করে তুলেছে। টেকনাফ সীমান্তে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পান আগুনের কুন্ডলী আর ধোঁয়া। যেন বিরাট অগ্নিকুন্ড- মুখে আজদাহা গ্রাস করছে সবকিছু। পালে পালে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অনুপ্রবেশ তাকে ব্যথিত করে। মানসিক চাপ বাড়ায়। দুঃসহ দৃশ্যপট এড়িয়ে তিনি ফিরে যান নিজ বাড়িতে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন যে, তার মামাবাড়িতেও বর্মী সেনারা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে আসতেই বুলেটে দীর্ণ করে দিচ্ছে তাদের দেহ, রক্তে-বারুদে একাকার সব। একাত্তরে ছাত্র থাকাকালে তিনি চলে যান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে বাবা-মা, স্বজন ও ঘরবাড়ি, চাষের জমি, বাড়িতে গড়ে তোলা বইয়ের পাঠাগার। সেখানে যুব শিবিরে কাজ পান মায়ের সহদোরা ডাঃ নুরুন্নাহার জহুর ও তার স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনএ জহুর আহমদ চৌধুরীর কল্যাণে। শরণার্থী জীবন কি কঠিন, কষ্টকর, নয় মাস ধরে বুঝেছিলেন হাড়ে হাড়ে। স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র ও বয়সে ছোট বলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের সুযোগ বঞ্চিত হলেও যুব শিবিরে প্রচুর কাজ করতে হতো। সেই শরণার্থী মুহম্মদ সবুর যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের করুণ অবয়বের দিকে তাকান, বুক তার ভেঙ্গে যায়। উচ্চারণ করেন, ‘এই কি মানুষ জন্ম।’ একাত্তরেই বুঝেছিলেন তিনি পরাজয়ের মধ্যে থাকে জয়ের বীজ। আবার পরাজয়ের সময় নানান সমস্যা ভুল বোঝাবুঝি দেখা দেয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো সামনে চলে আসতে চায়। তাকে দূরে সরিয়ে দিতে বাঙালী পারে একমাত্র নিজস্ব মতাদর্শ। একাত্তরে বাঙালী স্বাধীনতার মতাদর্শে রণাঙ্গনে লড়াই করেছে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জীবনে তো নেই কোন মতাদর্শ। বর্মী সোনা শাসকরা তাদের শিক্ষা-দীক্ষার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে শতকের পর শতক। মক্তব মাদ্রাসার জীবনে শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠেই জীবন সীমাবদ্ধ। কিন্তু অর্থ না জেনেই পাঠ করতে হয়েছে। একুশের কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পিতা, পিতৃব্যরা রেঙ্গুনে থাকতেন। সেখানে ছিল বিশাল সওদাগরী ব্যবসা। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রামও আসতেন। সড়কপথে আসা হতো না। দুর্গম পথ, গিরিখাত, গরুর গাড়িও চলে না। নৌপথেই করতে হতো যাতায়াত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপান দখল করে নেয় বার্মা। চালায় নিধনযজ্ঞ। সব ফেলে তারা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম আসছিলেন। পথিমধ্যে মগ দস্যুরা তাদের সবকিছু কেড়ে নেয় শুধু নয়, অনেককে হত্যাও করে। কবির পিতাও নৃশংস খুনের শিকার হন। বেঁচে যাওয়া অন্য সঙ্গীরা তার রক্তাক্ত শার্টটি নিয়ে এসেছিলেন। সেই জামা জড়িয়ে ধরে মাহবুব উল আলম অনেকদিন কেঁদেছেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একদিন তার কান্নার রোল এমনই উথলে উঠেছিল যে, আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম। আরকানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস। রাখাইনরা বৌদ্ধজাত। মগ জলদস্যুদের নির্যাতনে তাদের অনেকে শতবর্ষেরও আগে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে চলে আসেন। এখনও তারা সেখানেই বসবাস করেন। বার্মা তাদের কাছে ভিনদেশ। যে দেশে আর কোনদিন হবে না যাওয়া। রাখাইন বৌদ্ধরা এ দেশে শান্তিতেই বসবাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধেও এদের অনেকেই সরাসরি অংশ নিয়েছেন। এক বীভৎস হিংসার অভিযান চলছে এখনও রাখাইন রাজ্যে। এই পাশবিক অত্যাচারের আরও নানান দিক আছেÑ যার সবটা এখনও আমাদের নজরে আসেনি। এত ভয়ঙ্কর আক্রমণের মধ্যে যে ঘটনা আমাদের অসহ্য যন্ত্রণায় ফেলেছে, তাতে অন্তত মিয়ানমারকে সভ্য দেশ বলে ভাবতে গা শিউরে উঠছে। এর তুলনা একমাত্র মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে করা যায়। সে দেশে মানুষ অমানুষ হয়ে উঠবে এই একুশ শতকেও, দেখা দেবে সভ্যতার সঙ্কট বাংলাদেশ তা ভাবতেও পারে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সভ্যতা শব্দটার আসল মানে হচ্ছে সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করা। সভ্য শব্দের ধাতুগত অর্থ এই যে, যেখানে আভা, সেখানে আলোক আছে। অর্থাৎ মানুষের প্রকাশের আলো একলা নিজের মধ্যে নয়, সকলের সঙ্গে মিলল।’ মিয়ানমার নামক দেশটির শাসককুল এখনও বর্বরতায় নিজেদের মধ্যে প্রাণ পায়। আদি থেকেই দেশটির মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে নরাধমে পরিণত হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের অনুসারী দাবিদাররা বুদ্ধের শান্তির বাণীকে পরিহাসে পরিণত করেছে। বরং দস্যুবৃত্তির যে ধারা অতীতে তাদের মধ্যে দেখা গেছে, তারই ধারাবাহিকতায় বর্বরতার চূড়ান্ত পথ তারা অবলম্বন করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথকে আবারও স্মরণ করা যায়Ñ ‘জীবনের পরিধি সঙ্কীর্ণ হলে শুধু ইনস্টিংক্টের জোরেই চলে, কিন্তু বড় ক্ষেত্রে দেহ মন হৃদয়ের পরিপূর্ণ শিক্ষা চাই। বর্বরতার ক্ষুদ্র সীমায় ইনস্টিংক্টের স্থান আছে, সভ্যতার বড় সীমায় যে দুর্বল।’ যে পথ ক্ষমতা পাওয়ার জন্য, ভোটে জেতার জন্য মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে, মানবিকতাকে ধ্বংস করে, সাময়িক লাভের জন্য সে পথের যাত্রী কখনও সভ্যতার অংশীদারি হতে পারে না। যে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা তিল তিল করে গড়ে উঠেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে; তাকে ধ্বংস করছে সামরিক জান্তা শাসক এবং তার সহযোগী নোবেল জয়ী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী (!) আউং সান সুচি। জীবনের পরিধিকেই করে দিয়েছে ছোট। নিজ বাসভূমে দীর্ঘদিন পরবাসী হিসেবে থাকতে বাধ্য করে এখন নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে বাধ্য করছে দেশত্যাগে। সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির ওপর যে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসী বিস্মিত এবং হতবাক হলেও শক্তিধর দেশ ও তাদের রাষ্ট্রনায়কদের কাছে গুরুত্বহীন হয়েই কেবল থেকে যাবে এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কী তাদের অপরাধ? নিপীড়করাও তা জানে না। ওরা জানে এই সম্প্রদায়কে তাদের পিতৃভূমি থেকে নির্বাসিত করতে হবে। আর পরিত্যক্ত ভূমিতে গড়ে তোলা হবে কলকারখানা। যাতে ওরা আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবে না। আসলে আরাকান রাজ্যটিকে ‘মুফতে’ পেয়েছে মিয়ানমার। স্বাধীন রাজ্য আরাকান, যার অংশ ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রাম, চর্চা হতো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, সেই রাজ্যটিকে কব্জা করে বর্মীরা নাশকতা ও নারকীয়তাকে প্রাধান্য দিয়েছে, ব্রিটিশরা দেশভাগের সময় নাফ নদীর অপর পাড়ের আরাকান রাজ্যকে বর্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে। আর দক্ষিণ চট্টগ্রাম মূল চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে। স্বাধীন আরাকানীদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলা হয়। যার মাসুল গুনতে হচ্ছে আজও। আরাকানীরা দেশভাগের সময় আবেদন করেছিল চট্টগ্রামের তথা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করায়। তারা জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাত করতে চেয়েছিল কিন্তু জিন্নাহ পাত্তা দেননি। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু বার্মার সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানের সংযুক্তি যে ছিল ভুল সিদ্ধান্ত, তা গত চার দশকে স্পষ্ট হয়েছে। নিজ দেশে নাগরিকত্বহীন, ভোটাধিকারহীন, শিক্ষাহীন রোহিঙ্গারা মূলত দলিত শ্রেণীর চেয়েও অন্ত্যজ শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার পথ তাদের খুলে দিতে পারে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো। কিন্তু তারা মানবতার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বৈষয়িক বিষয়কে। আরাকান তেল, গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই ঈগল ও ড্রাগন এবং শকুনের দৃষ্টি রয়েছে এই অঞ্চলটির ওপর। রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে ফিরতে না পারে সে জন্য তাদের ভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকারখানা। চীন, ভারতসহ অন্যান্য দেশ সেখানে বিনিয়োগ করছে। বন কেটে বসত গড়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইংরেজ আমলে আরাকানীরা। আর আজ খেদানোর পর তাদের বসতিতে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পাঞ্চল। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা আরাকান তথা রাখাইনের ভূমিপুত্র, কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ে না বলেই উদ্বাস্তু জীবনের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে নিরন্তর। রাখাইনদের জীবনে শান্তি আর স্বস্তির দেখা মেলে না বহুকাল ধরেই। অষ্টাদশ শতকের চারের দশক থেকেই নিপীড়ন-নির্যাতন, প্রাণহানি তাদের কপাল লিখনে পরিণত হয়েছে। ওইসময় থেকে দেখা যায় বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব। ফলে তাদের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন ও অনিশ্চিত। যা তাদের মধ্যে শান্তি ও স্থায়িত্বের চেতনা জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু সে সবই ছিল তাদের জন্য দূরঅস্ত। আরাকানে সে সময়ের ক্রমাগত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ইংরেজ ও ফরাসী শক্তিকে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহী করে তুলেছিল। এ অবস্থায় ১৭৮৪ সালের শেষদিকে সাম্রাজ্যবাদী বর্মী রাজা আরাকানে অভিযান চালান। স্বাধীন আরাকান রাজ্যের রাজা হামদা পরাজিত হন ও ধরা পড়েন। আর আরাকান হয়ে ওঠে বার্মার অংশ। দখলের পর পরই আরাকানে বর্মী সেনারা নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। আরাকানীদের আটক করে নারীদের বার্মায় স্থানান্তর এবং পুরুষদের হত্যা করে। এই দমননীতির তোড়ে হাজার হাজার আরাকানী উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। এরপর বর্মীরা থাইল্যান্ড বা শ্যাম দেশ দখলের তোড়জোড় শুরু করে। তারা আরাকান হতে জোরপূর্বক প্রচুর সংখ্যায় লোকবল নিয়ে থাই সীমান্তে পাঠায়। একই সঙ্গে অস্ত্র রসদ সংগ্রহে আরকানীদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। এ জন্য আরাকানীদের একত্র করে মরিচের ধোঁয়া দেয়া ও বিভিন্ন দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। তারা পরাজিত আরাকানী সেনাদের অস্ত্র সমর্পণের জন্য প্রধান সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে হত্যা করত। যুবকদের ধরে নিয়ে বার্মায় পাঠানো হতো। যারা আর কখনও ফেরেনি। যেমন ফিরতে পারেনি ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারাও। বাংলাদেশ পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। এই শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীদের ভরণপোষণদান অত্যন্ত কষ্টকর। তথাপি রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীরা যে জল ঘোলা করতে সচেষ্ট হবে, তাতে সজাগ থাকা জরুরী। শরণার্থী রোহিঙ্গারা বিদ্যা অর্জন করতে পারেনি শাসকরা চায়নি বলে। যদি পারত তবে পাবলো নেরুদার কবিতাকে উচ্চারণ করে ফিরে পেত আত্মবিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসটাকেই দৃঢ় করে অবিচল থাকতে পারত। নেরুদা লিখেছিলেন, ‘‘আমরা যারা পাথরকেও দিয়েছি উত্তাপ, হয়েছি/ইস্পাত দৃঢ়, নিয়মানুবর্তিতা মেনেছি কঠোর/ভালোবাসাকেই করেছি একমাত্র প্রাণের সম্বল!/ আমরা তো জানতামই রক্ত ঝরাতে হবে!/আকাশের তারায়ও যখন ভাঙ্গন লাগে, মন/কিন্তু অশান্ত হয় চাঁদের গ্রহণ লাগা দেখে। তখন কি তোমরা একবারও ভাববে আমরা কারা, আমরা কি?/আমাদের ভাবনাকেই চিনবে; জানবে কি হতে চাইছি আমরা?/ শোনো আমরাই এ পৃথিবীর মহার্ঘ খনিজ/সত্য-উপাদানে গড়া প্রণমা মানুষ/সমুদ্রের অফুরান গতির সমান উদ্বেল/আমাদের ভিত্তি সুদৃঢ়/সাময়িক অসময়, আঁধি চোখকে করে না অন্ধ/দেশের কারণে যদি মৃত্যুও হয়/যেনো সে মরণে চেনা কোনো সন্তাপ থাকবে না।’’
×