ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল ॥ আকিয়াব থেকে সীমিত পরিসরে কিছু পণ্য আসছে

মিয়ানমার-বাংলাদেশ আমদানি রফতানি বাণিজ্য হুমকির মুখে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমার-বাংলাদেশ আমদানি রফতানি বাণিজ্য হুমকির মুখে

রহিম শেখ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস হামলার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করেছে। এই সহিংস পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধ। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। ২২ দিন ধরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে কোন পণ্য রফতানি হয়নি। টেকনাফের অপর পাড়ে অবস্থিত মিয়ানমারের ছোট শহর মংগদুর সঙ্গে আমদানি-রফতানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কোন ব্যাংক লেনদেনও হচ্ছে না। তবে সীমিত পরিসরে মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর থেকে কিছু পণ্য আসছে বাংলাদেশে। এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুটির কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করছে সরকার। ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, স্থলবন্দর হলেও টেকনাফ দিয়ে মূলত নদীপথেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানি করা হয়। ২০০৬ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ স্থলবন্দরে পাঁচটি কার্গো জেটি, একটি প্যাসেঞ্জার জেটি ও তিনটি পন্টুনও রয়েছে। মূলত, মিয়ানমার থেকে কাঠ, চাল, মাছ, শুঁটকি, আদা, হলুদ, আচার, তেঁতুল, চকলেট, মসলা, সবজি জাতীয় পণ্য, চিনি ও চিনি জাতীয় পণ্য, তৈল জাতীয় পণ্য, যন্ত্রাংশ ও মৌসুমি ফল আমদানি হয়। আর বাংলাদেশ থেকে যায় প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য, পাট ও পাট জাতীয় পণ্য, চামড়া, কৃষিপণ্য, সিমেন্ট ও ওষুধ। টেকনাফ স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ আগস্টের পর মংগদু থেকে কোন পণ্যের চালান আসেনি টেকনাফ স্থলবন্দরে। তবে আকিয়াব থেকে আটটি ছোট কার্গো জাহাজ এসেছে। তার মধ্যে ছয়টি জাহাজে ছিল চাল। এ ছাড়া মাছের কয়েকটি চালানও এসেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ৭৫০ টন চাল নিয়ে একটি জাহাজ এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দরের ট্রাফিক পরিদর্শক স্বপন চাকমা জনকণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমারের সহিংস ঘটনার পর এই বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি কমে গেছে। তবে স্থলবন্দরের কার্যক্রম যথারীতি চালু আছে। যেসব পণ্যের চালান আসছে, তা খালাস করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুটি কূটনীতিক সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি-ডায়ালগের সিনিয়র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমার বাংলাদেশের অন্যতম সীমান্তবর্তী দেশ। বাংলাদেশের বাণিজ্য অনেক না থাকলেও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে বাণিজ্য নতুন কোন দিকে মোড় না নেয়াই ভাল। যেসব ঘটনা ঘটছে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই শ্রেয়। অন্য বিষয় না এলেই ইতিবাচক হবে বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের তুলে ধরতে হবে, যাতে দ্রুত এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধান হয়। তবে সবকিছুতেই এই রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের চাপের মুখে রাখবে এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে। এর পরও দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ নয়। রোহিঙ্গা সঙ্কট কূটনীতিকভাবে সরকার মোকাবেলা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। টেকনাফ কাস্টমস কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে এই বন্দরে ৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা রাজস্ব লক্ষ্যের বিপরীতে ১০ কোটি ৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে আদায়ের লক্ষ্য ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। গত বুধবার পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৮০ লাখ টাকা। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে গত অর্থবছরে প্রায় ৮০ হাজার টন পণ্য আমদানি-রফতানি হয়েছে। এ সময়ে টাকার অঙ্কে মিয়ানমার থেকে ৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আসে। এর বিপরীতে মাত্র ২ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মিয়ানমার থেকে পণ্য আসে ৪৩ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ রফতানি করে মাত্র ৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশের। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বড় অংশই সম্পন্ন হয় চীনের মাধ্যমে। এর বাইরে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য কম হলেও চোরাই বাণিজ্য ব্যাপক। এর মধ্যে মিয়ানমার কৃষিপণ্য, মাছ, গবাদিপশু, তৈজসপত্র, পোশাকসামগ্রী, জুতা ব্যাপক আকারে আসে। বিশেষ করে কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পণ্যের একচেটিয়া বাজার রয়েছে। সূত্র মতে, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তির পর থেকেই শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি। সেই হিসাবে প্রতিবছরই উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। কিন্তু যে হারে বাণিজ্য বাড়ার কথা সে হারে বাড়ছে না। গত সাত অর্থবছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা কমে আসেনি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১০-১১ থেকে শুরু করে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত মিয়ানমারে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের পণ্য। তার বিপরীতে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৫৩ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। বিশাল এই বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে সরকারের ধীরগতিতে হতাশ ব্যবসায়ীরা। ট্যারিফ কমিশন সূত্র মতে, প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তবু বাড়েনি আমদানি-রফতানি। বাংলাদেশী পণ্যের রফতানির হার খুবই কম। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এসএম নুরুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে সব দেশে রফতানি করা যায় না। অনেক দেশ আছে যেখান থেকে আমদানি করতে হয়। আর মিয়ানমারের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেশি। যার কারণে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হয়। চায়না, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে মিয়ানমার অতি সহজে বিভিন্ন প্রস্তুত পণ্য আমদানি করতে পারে। আমাদের দেশ থেকে শুধু ওষুধ ছাড়া অন্য পণ্য দিতে পারি না। এ জন্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক বছর ধরেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশটির পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।
×