ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি আয়ে নতুন সম্ভাবনা চামড়া শিল্প

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রফতানি আয়ে নতুন সম্ভাবনা চামড়া শিল্প

‘ফরাসীদের ফ্রেঞ্চ কাফের’ পর মানের দিক থেকে বাংলাদেশের চামড়াই বিশ্বের সেরা বলে মনে করেন চামড়া বিশেষজ্ঞরা। এ রকম স্মুথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের অন্য কোথাও মেলে না। বিশ্ব বাজারে চামড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তৈরি চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের পরিচিতি বিশ্বের অন্যতম কাঁচা চামড়া রফতানিকারক দেশ হিসেবে। কাঁচা চামড়ার পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে জোর দেয়া হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হারও ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের চামড়ার মান ভাল হওয়ায় চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সরকারী-বেসরকারী তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী অর্থনীতিতে চামড়াশিল্পের অবদান দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চামড়ার তৈরি জুতাসহ চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়ছে। এ শিল্পের অধীনে আছে ২২০টি ট্যানারি, অসংখ্য জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও দর্শনীয় উপকরণ তৈরির কারখানা। সরাসরি এই শিল্পে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মচারী-কর্মকর্তা। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে চামড়া শিল্পের অবদান শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। রফতানি আয়ে এ খাতের অবদান ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আশার কথা গত তিন বছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি হয়েছে প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৩৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ১২৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এ হিসাবে মাত্র তিন বছরে রফতানি আয় বেড়েছে ২২৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৪২ কোটি ৮৫ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। আর এই রফতানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। এমনকি এটি এই সময়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়ার পাশাপাশি এখন জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রফতানি হয়? এছাড়াও চামড়ার তৈরি নানা ‘ফ্যান্সি’ পণ্যেরও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচুর হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এ সব পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বাজারে পাঠাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রফতনি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় শতকরা ৭ দশমিক ২৮ ভাগ বেশি। বাংলাদেশের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলো ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডা? এর বাইরে জাপান, ভারত, নেপাল ও অস্ট্রেলিয়াতেও বাজার গড়ে উঠছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিশ্বে বাংলাদেশী পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা জাপান? তাই মোট রফতানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ যায় জাপানের বাজারেই। এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশী চামড়ার জুতার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জাপান ‘ডিউটি ফ্রি’ ও ‘কোটা ফ্রি’ সুবিধা দিয়ে আসছে? বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার এখন ২১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের শতকরা ০.৫ ভাগ রফতানি করে। বিশ্বব্যাপী চামড়া রফতানিতে শীর্ষ দেশ চিন। দেশটি প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮১২ কোটি ৪৩ লাখ বর্গফুট চামড়া রফতানি করে। এর বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। চামড়া উৎপাদনে চীন যেমন শীর্ষে, তেমনি চামড়া রফতানিতেও প্রথম স্থানে রয়েছে দেশটি। আবার কাঁচা চামড়া আমদানিতেও শীর্ষ স্থান দখল করে রেখেছে বিশ্বের জনবহুল এ দেশটি। বিভিন্ন দেশ থেকে তারা কাঁচা চামড়া আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরির পর বিভিন্ন দেশে রফতানি করে। এ কারণে এ খাতে চীনের রফতানি অনেক বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইতালির চেয়েও তাদের রফতানি প্রায় তিনগুণ। ইতালির চামড়া রফতানির পরিমাণ প্রায় ২৮৪ কোটি ৫০ বর্গফুট, যার মূল্য প্রায় ১ হাজার ২৫ কোটি ডলার। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। ভারত রফতানি করে প্রায় ২১১ কোটি ৫৭ লাখ বর্গফুট চামড়া, যার মূল্য প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। ইতালি ও ভারত চামড়া রফতানির পাশাপাশি বিদেশ থেকে কাঁচা চামড়াও আমদানি করে। সেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রফতানি করে। চামড়া রফতানিতে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল। ল্যাটিন আমেরিকার এ দেশটি বছরে রফতানি করে প্রায় ২১১ কোটি ৩১ লাখ বর্গফুট চামড়া, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭৬১ কোটি ডলার। নিজের দেশে উৎপাদিত চামড়া দিয়ে পণ্য তৈরি করে সেগুলো রফতানি করা হয়। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির বছরে রফতানির পরিমাণ ১৯৪ কোটি ৬৬ লাখ বর্গফুট চামড়া, যার মূল্য প্রায় ৭০১ কোটি ডলার। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে আর্জেন্টিনা। তারা বছরে রফতানি করে প্রায় ৯৪ কোটি ৫২ লাখ বর্গফুট, যার মূল্য প্রায় ৩৪১ কোটি ডলার। সফতম স্থান দখল করে রেখেছে মেক্সিকো। দেশটি বছরে রফতানি করে ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ বর্গফুট, যার মূল্য প্রায় ২৪৭ কোটি ডলার। অষ্টম স্থানে রয়েছে তুরস্ক। বছরে রফতানির পরিমাণ ৭৪ কোটি ২৩ লাখ বর্গফুট, যার মূল্য প্রায় ২৬৮ কোটি ডলার। নবম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতাধর এ দেশটি বছরে চামড়া রফতানি করে ৬৬ কোটি ৯১ লাখ বর্গফুট, যার মূল্য প্রায় ২৪১ কোটি ডলার। দশম অবস্থানে আছে স্পেন। দেশটি রফতানি করে ৫৮ কোটি ৭৯ বর্গফুট। এর বাজারমূল্য প্রায় ২১২ কোটি ডলার। তবে এবার কোরবানির পশুর চামড়া কেনাবেচায় দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা চলছে। কোথাও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বেশ কম দামে চামড়া কিনে চড়া দামে বড় ব্যবসায়ী বা আড়তদারের কাছে বিক্রি করেছেন। কোথাও মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা মাঠপর্যায় থেকে বেশি দামে কিনে আড়তে কম দামে, অর্থাৎ লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কোথাও বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে বেশি দামে চামড়া কেনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েছেন।
×