ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশের সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশের সতর্কতা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে শরণার্থী শিবির ব্যতীত রোহিঙ্গাদের বসবাস পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কোন প্রকার আশ্রয়প্রশয়, বাসা ভাড়া, চাকরি, বসবাসের ব্যবস্থা, অন্যত্র চলে যেতে সহায়তা না করতে পুলিশ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যেই পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশ মোতাবেক রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছাড়াও সীমান্তবর্তী জেলা ও বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করার সময় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে শিবিরে পাঠানো হয়েছে। শনিবার পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। সরকারের তরফ থেকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাদের জন্য ইতোমধ্যেই অনেক বাসস্থান নির্মিত হয়েছে। আরও হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা ও খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্যাম্পে অবস্থান করতে হবে। অনেক রোহিঙ্গা এদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছেন। রোহিঙ্গাদের অবস্থান এবং যাতায়াত শুধু কক্সবাজারের নির্দিষ্ট ক্যাম্পগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকবে। তারা ক্যাম্পের বাইরে তাদের আত্মীয়-স্বজন অথবা পরিচিত ব্যক্তিদের বাড়িতে অবস্থান বা আশ্রয় নিতে পারবেন না। তাদের কাছে কেউ বাসা ভাড়া দিতে পারবেন না। কেউ রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িতে বা তার হেফাজতে বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। রোহিঙ্গারা নির্দিষ্ট ক্যাম্পের বাইরে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে অথবা যাতায়াত করতে পারবেন না। তারা সড়ক বা রেলপথ বা নৌপথে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারবেন না। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কোন পরিবহনে বহন না করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেউ আশ্রয় বা বাড়ি ভাড়া দিতে পারবেন না। এমনকি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সহায়তা করতে পারবেন না। কোন রোহিঙ্গা একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করলে তা স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সদর দফতর থেকে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশেই পুলিশ বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। তল্লাশিতে ইতোমধ্যেই কয়েক শ’ রোহিঙ্গা শনাক্ত হয়েছে। তাদের সরকার নির্ধারিত শরণার্থী শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি, মানিকগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলছে। এসব জেলায় কার্যক্রম থাকা চেকপোস্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়া রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল। এছাড়া আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করার কাজ চলছে পুরোদমে। এক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করছিলেন বাংলাদেশে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা। অনেক বিতর্কিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়প্রশয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সদর দফতরের উর্ধতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমানে দেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ভাষা ছাড়া বাকি সবই প্রায় বাংলাদেশীদের মতো। এমন সুযোগে তারা স্বেচ্ছায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। আর তাতে মদদ যোগাচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। তারা নির্যাতিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ভবিষ্যতে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তার প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিভিন্ন কর্মকা-ে। বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধীরা রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে তারা কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। তারা নিজস্ব পরিবহনে এবং আর্থিকভাবে সহায়তা করে রোহিঙ্গাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় পার করে দেয়ার চেষ্টা করছে। এসব নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে দিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মকা-ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠন নেপথ্যে থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়প্রশয় দিচ্ছে তাদের বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রয়োজনে তাদের সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে জেরা ছাড়াও আইনের মুখোমুখি করা হতে পারে। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও জানান, দেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আগাগোড়াই যোগাযোগ ছিল। এখনও আছে। কক্সবাজারের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান ও তার ভাই উপজেলা জামায়াত নেতা শাহজালালের সহোদর বোনের বিয়ে হয়েছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান মোহাম্মদ সেলিম উল্ল্যাহর সঙ্গে। সেলিম উল্লাহ ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি হুজি নেতা মুফতি হান্নান, হামলায় অংশ নেয়া আবু জান্দাল, ভারতের তিহার জেলে বন্দী সহোদর জঙ্গী মুরসালিন ও মুত্তাকিনকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ উল্লাহ বর্তমানে জাপানে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জঙ্গীবাদে জড়িত করা এবং তাদের পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং দেয়ার কাজটি সরাসরি করছেন আব্দুল করিম টু-া। তিনি রোহিঙ্গা নাগরিক। অনেক আগে তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি করে এদেশের নাগরিক সেজে বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। তিনি পুরোপুরি জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। আব্দুল করিম টু-া বাংলাদেশের জেএমবির কারাবন্দী আমির ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই পাকিস্তানে নিহত জেএমবির শীর্ষ নেতা ইজাজ ওরফে কারগিলের সঙ্গে পাকিস্তানের একই জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিলেন। কারগিলের মাধ্যমে টু-ার সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ও বাংলাদেশের জামায়াতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা, বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী জঙ্গীরা বাংলাদেশ দিয়ে প্রবেশ করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হামলা চালাতে পারে। এজন্য বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সুনামগঞ্জ থেকে ১২ ও মানিকগঞ্জ থেকে ২০ রোহিঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে শরণার্থী ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফেরত পাঠানো রোহিঙ্গাদের যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জ থেকে উদ্ধার হওয়া ১২ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া ব্যক্তি জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাঘাঁটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার অভিযোগ আনা হয় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির বিরুদ্ধে। এরপর থেকেই সেখানে সেনাবাহিনী ব্যাপক মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে আসছে। নিপীড়নের মাত্রা এতটাই মারাত্মক যে, রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। উল্লেখ্য, জাতিগত দাঙ্গাসহ নানা নির্যাতনের কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বসবাস করছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়াসহ বেশ কিছু জায়গায় তাদের বসবাস।
×