ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনজুড়ে নিধন অব্যাহত ;###;শনিবারও এসেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ;###;জিরো পয়েন্টে মিয়ানমারের সেনা টহল ;###;সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে বিজিবি

বিশ্ব জনমতের প্রতি তোয়াক্কা নেই মিয়ানমারের ॥ জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিশ্ব জনমতের প্রতি তোয়াক্কা নেই মিয়ানমারের ॥ জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যাসহ অমানুষিক দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সশস্ত্র অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে মিয়ানমার বাহিনীর নারকীয় তা-বের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে চললেও সেখানকার চলমান যৌথ অভিযানে নৃশংস বর্বরতা কেবল বেড়েই চলেছে। এ যেন বিশ্ব জনমতের প্রতি মিয়ানমারের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন। ইতোমধ্যে সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশু প্রাণ হারিয়েছে। আর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে লাখ লাখ। যে সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছতে পারে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কোন আবেদন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী আমলে আনছে না। বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও রোহিঙ্গা বিতাড়ন তৎপরতা চলমান রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, রক্তের এই হোলি খেলা থেকে মিয়ানমারকে থামাবে কে? এত নিষ্ঠুর ও হিংস্র অভিযান চালাতে মিয়ানমারকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দানকারী কারা সে নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। শনিবারও রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামে আগুন দেয়া হয়েছে। জ্বলে-পুড়ে ভস্মীভূত হচ্ছে একের পর রোহিঙ্গাদের বসতি। ফলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশও থামছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার থেকে জঙ্গীমনা গোষ্ঠীর সদস্যরা যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষ্যেই শনিবার থেকে সীমান্তের সকল কর্মকা- আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। অপরদিকে, ইতোমধ্যেই দফায় দফায় মিয়ানমার বাহিনীর হেলিকপ্টার ও ড্রোন বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। বিজিবির পক্ষে মিয়ানমার সরকারের কাছে এ নিয়ে সরাসরি প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সরকারের পক্ষে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে এ পর্যন্ত তিন দফায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে পরিস্থিতি জানানো হয়েছে এবং সে দেশের সামরিক বাহিনীর বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান মিয়ানমার সরকার এসব বিষয়ে কোন কর্ণপাত করছে না। আন্তর্জাতিক সকল আইনকানুন লঙ্ঘন করে সে দেশের সেনাবাহিনীর সীমান্তের জিরো পয়েন্টগুলোতে টহল দান অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে বিজিবি সদস্যদের নতুন করে সতর্কাবস্থানে নেয়া হয়েছে। এদিকে, ইউনিসেফের তথ্য মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে শুধু শিশুর সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। আইওএম, ইউএনএইচসিআরসহ বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দেশীয় সাহায্য সংস্থাগুলো ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা আরও বেড়েছে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়, খাদ্যসহ সব ধরনের চাহিদা মেটাতে সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সরকারী পর্যায়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ৩২টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। আর রোহিঙ্গারা যাতে নির্ধারিত স্থান থেকে চলে যেতে না পারে সে জন্য কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুলিশের ২৭টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ওপারে সর্বহারা হয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা এপারে এখন টিকে থাকার সংগ্রামে লড়াই করছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মানবিক সহায়তা ও আশ্রয় দানের কথা বার বার পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা আধিক্যে গোটা কক্সবাজার অঞ্চল এবং বান্দরবানের আংশিক এলাকা রীতিমতো বিপর্যস্ত। বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল দিন দিন বেড়েই চলেছে। শনিবারও টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ ঘোলার চর, মাঝের পাড়া, পশ্চিম পাড়া, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যং, বালুখালী, রহমতেরবিল, ঘুমধুম জলপাইতলী ও তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নৌকায় করে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। সীমান্তে আসার পর পরই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষরা রোহিঙ্গাদের হাতে কেউ টাকা, আবার কেউ কেউ তাদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছে। শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফের দিকে আসা রাস্তায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। আর রাস্তার দুই পাশে বসানো হয়েছে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ সামগ্রীর দোকান। কেউ কেউ সেখান থেকে পলিথিন নিয়ে রাস্তার পাশে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে। স্থানীয় পর্যায়ে এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ নিয়ে এসে বণ্টন করার দৃশ্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কিন্তু ত্রাণ বণ্টনে কোন রকমেই শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে একাধিক টিম গঠন করেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সার্বক্ষণিকভাবে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাচারকারী ও চোরাকারবারিরা সক্রিয় ॥ চলমান রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিতে ইয়াবা চোরাকারবারি ও মানবপাচারকারীরাও ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়েছে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে নৌযান টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সাগরপথে আনাগোনা করছে। এসব নৌকায় আসছে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা। সঙ্গে সক্রিয় হয়েছে ইয়াবা চোরাকারবারিরাও। বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। এ অবস্থায় টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত মানবপাচারকারী দলও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কেননা, রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ ওইসব দেশে চলে যেতে আগ্রহী। ওইসব দেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের গ্রহণের ঘোষণার পর থেকে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হয়েছে। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর হোসেন জানিয়েছেন, সাগরে নিয়মিত মাছ ধরার নৌকাগুলো এখন রোহিঙ্গাদের এ দেশে নিয়ে আসার কাজে নিয়োজিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা এই অবৈধ তৎপরতায জড়িয়ে পড়েছে। শনিবার উখিয়া ও টেকনাফের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা যে যেভাবে পারছে পালিয়ে আসছে এবং আশ্রয় নিচ্ছে এ অঞ্চলে। সরকারী নির্দেশে যেহেতু তাদের পুশব্যাক প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে সে সুযোগে রোহিঙ্গাদের আগমনের ঢলও থামছে না। তবে অবৈধ অনুপ্রবেশে সহায়তা দানের তৎপরতায় জড়িত হওয়ার দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত নৌকার মাঝি ও দালালদের জরিমানাও করছে। টেকনাফের সাবরাং নয়া বাজার থেকে উখিয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটারজুড়ে রাস্তার দু’পাশে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অবস্থান এখন অনেকাংশে কমেছে। সরকারী প্রক্রিয়ায় এদের বালুখালীর নির্দিষ্ট স্থানে জমায়াতের ব্যবস্থা কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখনও প্রতিদিন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। যেসব রোহিঙ্গা বসতি অবশিষ্ট ছিল সেগুলোও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমার সেনা ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের পক্ষে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ফলে পথিমধ্যে শত শত রোহিঙ্গা বসতি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এরই ফলে বাড়িঘরহারা রোহিঙ্গাদের ঢেউ পড়েছে এপারে। অনুপ্রবেশকারী নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পুরনো রোহিঙ্গারাও এখন এক শিবিরে অবস্থান নিয়েছে। উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প ও বস্তিতে পৃথক করার কোন সুযোগ নেই। উখিয়ায় ৫টি ক্যাম্পের মধ্যে বেসরকারী হিসেবে তাজনিরমার খোলা ক্যাম্পে দুই লাখ, হাকিরপাড়া ক্যাম্পে দেড় লাখ, জামতলী ক্যাম্পে ৫০ হাজার, বালুখালী ক্যাম্পে দুই লাখ, থাইংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০ হাজার, লাম্বার এশিয়া পাহাড়ে ১ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে অবস্থান করছে। ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলে নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গারা হামলে পড়ছে। তিন গ্রামে আগুন ॥ শুক্রবার ২টি ও শনিবার ১টিসহ মংডুর তিনটি রোহিঙ্গাপল্লী সেনা ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেখানকার রোহিঙ্গা গ্রাম নয়াপাড়া, কাজিবিল এবং রাবাইল্লা। এসব গ্রামের অধিকাংশ রোহিঙ্গা সেনা তা-বের ভয়ে আগেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তবে যারা সাহস করে থেকে গিয়েছিল, তাদের ওপর চলেছে অমানবিক নির্যাতন। আগুনে পুড়ে গেছে সাড়ে চার শতাধিক বাড়ি, নয় মসজিদ ও সাত মক্তব। প্রায় গ্রাম এখন রোহিঙ্গাশূন্য ॥ সেনা বর্বরতায় মংডুর প্রায় গ্রাম এখন রোহিঙ্গাশূন্য। তবে বুচিদং শহরের বেশ কিছু গ্রামে এখনও রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। তারা সমূহ বিপদের আশঙ্কার মধ্যে দিনযাপন করছে। রাচিদংয়ে ২৪াট বড় রোহিঙ্গা পল্লীর ২২টিই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যে দুটি গ্রামে এখনও রোহিঙ্গাদের অবস্থান রয়েছে তারা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। আইএমওর পরিসংখ্যান ॥ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিডিয়া সমন্বয়কারী ক্রিস লোম শনিবার জানিয়েছেন, উখিয়া, টেকনাফ ও তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে দিয়ে এ পর্যন্ত ৪ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে পৌঁছেছে। আর এ কারণে সীমান্ত এলাকার প্রত্যেকটি স্থান এখন রোহিঙ্গা আধিক্যে জর্জরিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসহ সব বিষয়ে চলছে এক ধরনের হাহাকার। এরপরও সরকারের মানবিক সহায়তা এবং বেসরকারী পর্যায়ে বিপুল পরিমাণে ত্রাণ বিতরণের কারণে রোহিঙ্গাদের কেউ অনাহারে নেই। ক্ষুধা নিবারণে তারা কোন না কোন সহায়তা পাচ্ছে। সাহায্য সংস্থাগুলোর মতে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এখন কাজ করছে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ডব্লিউএমএফপি, ও আইএসসি। এছাড়া দেশীয় বহু এনজিও রোহিঙ্গাদের সার্বিক সহায়তায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আগেই জানানো দেয়া হয়েছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ আগাম বার্তায় অনুমিত হচ্ছে প্রতিদিন যে হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তা আগামীতে সত্যে পরিণত হবে। কিন্তু সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশী অঞ্চলগুলোতে যেসব মানুষের বসবাস রয়েছে তাদের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে। কেননা, হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় তাদের ওপর বড় ধরনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এরপরও স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় পিছপা হচ্ছে না। স্থানীয়দের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়, আগেও ছিল পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। বর্তমানে আরও নতুন পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গার আগমন ঘটেছে। এতে সরকার সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিশ্চিতের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সফলতার মুখ দেখতে দীর্ঘ সময় নেবে বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আর সরকারী উদ্যোগে যে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে তা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি না করলে এ প্রক্রিয়া কেবলই বিলম্বিত হতে থাকবে বলে বিভিন্ন সূত্রে ধারণা দেয়া হচ্ছে। শরণার্থী নয় আশ্রিত ॥ ইতিপূর্বে আসা রোহিঙ্গা ছিল নিবন্ধিত। তাই তারা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এখন যারা আসছে তারা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত। তবে তারা আশ্রিত। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর সরকার এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগ পর্যন্ত তারা আশ্রিত হিসেবেই বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারবে। মোবাইলে রোহিঙ্গার টাকা লেনদেন ॥ টেকনাফ-উখিয়া ও কক্সবাজার সদরের কিছু কিছু মোবাইলের দোকানে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এসব টাকা কোথা থেকে আসে? কোন্ সংস্থা বা কে দিচ্ছে? আবার বিভিন্ন স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী চিহ্নিত ক্যাডাররাও (রোহিঙ্গা জঙ্গী) একাধিক নম্বর থেকে হাজার হাজার টাকা তুলে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু কিছু নগদ টাকা রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিয়ে ভিডিও ধারণ করে বিদেশে ইন্টারনেটে পাঠানোর প্রক্রিয়াও লক্ষণীয়। এ বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন ॥ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশী অপারেটরদের সিম ব্যবহার করছে। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই তারা কিনতে পারছে এ দেশের অপারেটরদের সিম। মূলত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার্থে রোহিঙ্গাদের সিম ক্রয়ের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের হাতে মোবাইল সিম পেতে সহযোগিতা দিচ্ছে স্থানীয় অনেকে। নিবন্ধনের চেয়ে ত্রাণের জন্য ঝোঁক বেশি ॥ রাখাইন রাজ্যে চলমান জাতিগত সহিংসতায় প্রাণরক্ষার্থে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিতে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করা হলেও এতে তাদের আগ্রহ খুব বেশি নয়। ত্রাণের প্রতি ঝোঁক বেশি। ত্রাণদান প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলায় আনা যায়নি। ফলে কেউ কেউ একাধিকবার ত্রাণ পাচ্ছে আবার কেউ পাচ্ছেও না। তবে যাই হোক, যারা পাচ্ছে তাদের অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেও দেখা যাচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা গেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বাধাও প্রদান করছে। তাদের এই বলে উস্কে দেয়া হচ্ছে যে, নিবন্ধিত হলে তাদের পুনরায় ফেরত পাঠানে হবে। এছাড়া বাংলাদেশে অবৈধভাবে পরিচয়পত্রসহ বাংলাদেশী হিসেবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকে নিবন্ধন থেকে দূরে সরে রয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দিন দিন এ প্রক্রিয়ায় জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এক মায়ের আহাজারি ॥ টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে নৌকা উল্টে ডুবে যাওয়ায় নিজের কোলে রেখেও ছেলেকে বাঁচাতে পারেনি মা হামিদা খাতুন। তার যমজ দুই সন্তানের বয়স মাত্র ৪০ দিন। তাদের বাবা রশিদ আহমদ গত ৩১ আগস্ট সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে। ওই দিন বিকেলে সেনা সদস্যরা তাদের গ্রামে হামলা চালায়। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করলে যে যে দিকে পারে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় তার স্বামী রশিদ আহমদ কোন্ পথে চলে গেছে তা তার জানা নেই। সে তার দুই যমজ সন্তানকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে এসেছে। প্রাণ বাঁচাতে দুই যমজ শিশুকে নিয়ে প্রথমে মিয়ানমারের রাচিদং শহরের পিন্দং থেকে পালিয়ে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় ও পরে ছোট বোন মাহমুদা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিমপাড়া সাগর উপকূলে নৌকাটি উল্টে ডুবে যায়। তখন তার কোলে মাবুদ আর খালার কোলে ছিল করিম। পরে তাদের দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের সহযোগিতায় করিমকে বাঁচানো সম্ভব হলেও মাবুদ মারা যায়। ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার ত্রাণ এলো ॥ রোহিঙ্গাদের জন্য ইরান সরকারের পাঠানো ৪১ টন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সে দেশের একটি বিমান চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম রাহিমপুর এ ত্রাণসামগ্রী চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন। ত্রাণের মধ্যে রয়েছেÑ তাঁবু, কম্বল, চিনি, তেল, বস্ত্রসহ ৯ ধরনের পণ্যসামগ্রী। ত্রাণ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ইরানী উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের যে মানবিক সহায়তা প্রদান করছে তাতে তারা গর্বিত। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে ত্রাণের দ্বিতীয় চালানও এসেছে শনিবার। এর আগে এসেছে মালয়েশিয়া, মরক্কো ও ভারতের ত্রাণ। ইন্দোনেশিয়ার ত্রাণের চালানটি দ্বিতীয়। শিখ ধর্মাবলম্বী সংস্থার ত্রাণ সহায়তা ॥ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তায় কাজ করছে শিখ ধর্মাবলম্বীদের একটি মানবিক সহায়তা সংগঠন। শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দা সিংজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ‘খালসা এইড’ নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ সংগঠনটি টেকনাফ উপজেলার গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা শুরু করে। খালসা এইড ভারত শাখার পরিচালক অমরপ্রিত সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাব থেকে আসা একদল স্বেচ্ছাসেবক শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে অমরপ্রিত গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা ৫০ হাজার অসহায় রোহিঙ্গার মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারের বাধা ॥ বর্তমানে মিয়ানমারে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাট্রিক মারফিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শনে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে শনিবার উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ মন্ত্রীকে রাখাইনের মংডু জেলার কোন স্থানে যেতে দেয়া হবে না বলে মিয়ানমার সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেও রোহিঙ্গাদের প্রতি দমন-পীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়েছে। রাখাইনে মানবিক সঙ্কট সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ এবং ত্রাণ ও মানবাধিকারকর্মীদের রাখাইন রাজ্যে প্রবেশে চাপ তৈরির উদ্দেশ্যে এ উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে রয়েছেন। হবিগঞ্জে রোহিঙ্গা যুবক আটক, উখিয়া ক্যাম্পে প্রেরণ নিজস্ব সংবাদদাতা, হবিগঞ্জ, ১৬ সেপ্টেম্বর ॥ আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেসে এসে হবিগঞ্জের উপজেলা মাধবপুরের শাহজীবাহার স্টেশনে নামার পর সাইফুল ইসলাম (২৮) নামে এক রোহিঙ্গা জনতার হাতে আটক হয়েছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদশেষে স্থানীয় পুলিশ শনিবার রাতে তাকে পুনরায় কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়েছে। সে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের থিংগাও থানার হাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা জনৈক সাহেব আলীর পুত্র বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। তবে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর অনেকটা অভুক্ত এই যুবক ছিল খুবই ক্লান্ত। কুড়িগ্রামে পাওয়া গেল আরেক রোহিঙ্গা পরিবার স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ইউনিয়ন পাথরডুবির দিয়াডাঙ্গা গ্রামে সন্ধান পাওয়া গেছে একটি রোহিঙ্গা পরিবারের। আবুল কালাম (৩০), স্ত্রী সফিকা (২০) এবং তাদের দু’কন্যা সন্তান রোজিনা (৪) ও রোকেয়াকে (৩) নিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে ওই গ্রামের জনৈক লাভলুর বাড়িতে। আবুল কালাম জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থানার তারাশু গ্রামের বাসিন্দা তারা। বার্মিজ সেনাবাহিনীর আক্রমণে সে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। প্রাণ বাঁচাতে তারা দেড় মাস আগে নাফ নদী পেরিয়ে চট্টগ্রামের উখিয়ায় প্রবেশ করে। সেখানে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিবারটির পরিচয় হয়। তার বাড়ি উপজেলার ভুরুঙ্গামারী সদর ইউনিয়নে। তিনি মায়া করে আমাদের ভুরুঙ্গামারীতে নিয়ে আসেন। সেখানে বাসস্ট্যান্ড এলাকার মৃত নেকাত ব্যাপারীর পুত্র বাবলু হাজীর বাড়িতে আশ্রয় নেই। নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যক্তি আমাদের পাথরডুবি ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত গ্রাম দিয়াডাঙ্গায় তার শ্বশুর রশীদ মিয়ার বাড়ির পাশে লাভলুর বাড়িতে আশ্রয় দেয়।
×