ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডোকলাম ইস্যু ॥ মোদির চালে পরাস্ত চীন!

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ডোকলাম ইস্যু ॥ মোদির চালে পরাস্ত চীন!

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৫৬ ইঞ্চি ছাতির গরিমা নিয়ে বিরোধীরা প্রচুর তির্যক মন্তব্য ও কটূক্তি করে থাকে। তাঁকে উপহাসের পাত্র করে অনেক নিম্ন স্তরের সমালোচনা ও নিন্দামন্দ করেছেন বিরোধী নেতৃবৃন্দ। বিশেষ করে রাহুল গান্ধী ও চরমপন্থীরা। কিন্তু ডোকলামে ৭৩ দিন ধরে ভারত চীনের চোখে চোখ রেখে বেজিংয়ের মরু আগ্রাসী ভূমিকাকে যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করল তাতে তাঁর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলে-ফেঁপে ৭২ ইঞ্চি বা তারও বেশি হবার কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে চরম দক্ষতার সঙ্গে ভুটানের ডোকলাম মালভূমিকে চীনের অভিসন্ধিমূলক জবরদখলের আগ্রাসী চালকে ব্যর্থ করলেন তা সাম্প্রতিককালে ভারতের অন্য কোন প্রধানমন্ত্রী করতে সক্ষম হননি। তাঁর কূটনীতির চালে পরাস্ত হয়ে চীনের নেতৃত্ব শুধু নিজেদের মুখই পোড়ায়নি, তাদের নয়া সম্প্রসারণবাদের মুখোশও খসে পড়েছে। যার ফলে বিশ্বজুড়ে চীনের ভাবমূর্তি এক বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। ১৯৬২ সালে নেহরুর অবিমৃশ্যকারিতায় চীনা আগ্রাসনের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ভারত যে হীনম্মন্যতায় ভুগত সেটা ডোকলাম কা-ের পর অনেকটাই সে কাটিয়ে উঠেছে। বরং বলা যেতে পারে চীনের রণহুংকার ও হম্বিতম্বিকে মোদি কোন পাত্তা না দিয়ে এবং বেজিংয়ের কাছে নতজানু না হওয়ার সাহস দেখিয়ে বিশ্বজুড়ে ভারতের মানমর্যাদাকে সম্ভ্রমের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। সেই কারণে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো এখন চীনের তুলনায় ভারতের প্রতি আরও বেশি আস্থাশীল। কারণ, তারা জেনে গেছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দাদাগিরির যোগ্য জবাব দেবার ক্ষমতাধর একমাত্র ভারত। শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোই নয়, সুদূর প্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম ভারতের রুখে দাঁড়ানোয় রীতিমতো মানসিক বল ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। এই দেশগুলো দক্ষিণ চীন সমুদ্রের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে এক ঘোর বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। ওই সমুদ্রের গভীরে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ভা-ার আছে। তার সঙ্গে আছে প্রচুর সামুদ্রিক মাছের উৎস। আর সেই জন্য চীন এই পুরো সমুদ্রকে গাজোয়ারি করে নিজের জলসীমানার অংশ বলে একতরফা ঘোষণা করেছে। ওই সমুদ্রে এবং লাগোয়া অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জনমানবশূন্য দ্বীপ আছে, যেমন সেনকাকু, যা জাপানের সামুদ্রিক জলসীমার মধ্যে পড়ে। ইতিহাসের দলিল-দস্তাবেজ প্রমাণ করে এই দ্বীপগুলো জাপানের। কিন্তু চীন তার আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সেনকাকুকে নিজের বলে দাবি করছে এবং জাপানকে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করছে সেখানে কোন নৌযান ও বিমান না পাঠাতে। ওই সমুদ্রে ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্সের উপকূল এলাকার অদূরে বেশ কয়েকটি দ্বীপ আছে, যা আন্তর্জাতিক জলসীমার আইন অনুযায়ী ওই দুটি দেশের অংশ বলে গণ্য হয়ে আসছে। কিন্তু বেজিং তা মানতে নারাজ এবং জোর করে সেগুলোর দখল নিয়েছে। সেখানে প্রচুর মাটি ও পাথর ফেলে দ্বীপগুলোর আয়তন বৃদ্ধির কাজে জোরেশোরে নেমেছে। পুরো দক্ষিণ চীন সমুদ্রকে নিজের দেশের অংশ বলে চালানোর চেষ্টা করছে। সেখানে বিদেশী জাহাজ ও বিমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেজিংয়ের এই একতরফা দাদাগিরির সিদ্ধান্ত জাপানের মতো দেশও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালত চীনের এই চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত নাকচ করলেও বেজিং ওই আদালতের সিদ্ধান্তকে মানতে নারাজ। চীনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত জলসীমার আইন মেনে চলার নির্দেশ দিলেও বেজিং তা মানছে না। সুতরাং এহেন চীন যখন গত জুন মাসে ডোকলাম উপত্যকাসংলগ্ন এলাকা যেখানে তিনটি দেশ ভারত, ভুটান ও চীনের সীমান্ত এসে মিশেছে সেটিকে নিজের বলে দাবি করে সেখানে প্রচুর সৈন্য-সামন্ত পাঠায় তার দখল নিতে, তখন সারা বিশ্বের নজর ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর। তিনি চীনা চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করেন তার ওপর জাপান, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার নেতারা তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তারা জানত চীন ডোকলাম দখল করলেই ভারতের প্রতিরক্ষার নিরিখে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকা ‘চিকেনস নেক’ চীনের কামানের গোলার নাগালে চলে আসবে এবং কালক্রমে চীন এই করিডর দখল করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দেশের মূল ভূখন্ড- থেকে বিচ্ছিন্ন করে এটারও দখল নেবে। মাত্র ১৭ কিলোমিটার চওড়া এই করিডর যা উত্তরে ভুটান ও দক্ষিণে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখ-ের এটাই একমাত্র সংযোগকারী ‘লাইফলাইন’। বেজিং অনেক অঙ্ক কষে ডোকলাম দখলের অভিযানে নামে। চীনা নেতারা ভেবেছিল জোর করে ডোকলাম নিজের দখলে নিলে ক্ষুদ্র ও দুর্বল ভুটান প্রতিরোধ করার সাহস পাবে না। আর ভারত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রও ভুটানের সমর্থনে এগিয়ে এসে চীনের সঙ্গে খামোখা সংঘর্ষে লিপ্ত হবে না। চীনা নেতৃত্ব ভেবেছিল ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের অভিজ্ঞতা ভারতীয় নেতৃত্ব ও সেনা বাহিনীকে দুঃস্বপ্নের মতো এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুতরাং ভুটানের মতো দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ভারত চীনের সঙ্গে অযথা ঝুটঝামেলায় জড়াবে না। মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে চীন ভারতকে হুমকি-ধমকি দিয়ে অনেকটা বাগে আনতে পেরেছিল। আর ডোকলাম নিয়ে ভারত যদি কিছু বলার চেষ্টা করে তাহলে হুমকি-ধমকির মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিলেই ভারত চীনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চীনা নেতৃত্ব চিনতে ভুল করেছিল। ভারতের এই প্রধানমন্ত্রী যে অন্য ধাতুতে গড়া সেটা তারা জানত না। জানলে ডোকলাম নিয়ে এমন মূর্খামি করত না। ডোকলাম ভুটানের হলেও তাকে ঘিরে যে ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও মানমর্যাদা জড়িত সেটা বুঝতে তার কালবিলম্ব হয়নি। ডোকলাম অভিযান যে চীনের আগ্রাসী নীতির প্রতিফলন তা বুঝতে পেরেই তিনি জওহর লাল নেহরুর মতো গড়িমসি না করে সেনাবাহিনীকে চীনাদের প্রতিরোধ করতে বলেছিলেন। ভারতের সেনাবাহিনীর বীর জওয়ানেরা কোন গোলাগুলি না ছুড়ে শুধু বুক চিতিয়ে ডোকলাম প্রতিরোধের দেয়াল খাড়া করেছিল, যা চীনা বাহিনী বারবার চেষ্টা করেও লঙ্ঘন করতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদি জানতেন প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম তিন বছরের মেয়াদকালে ডোকলাম সঙ্কট মোকাবেলাই হচ্ছে তাঁর সবচেয়ে বড় এবং কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। কারণ ডোকলামে চীন ভারতকে যে ধরনের স্নায়ু ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছিল তাতে ভারত যদি এটে উঠতে না পারে তাহলে দিল্লীর পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের একাধিপত্য ঠেকানো খুবই মুশকিল। ফলে ভারতকে চীনের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোই নয়, সুদূর প্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যারা চীনের গাজোয়ারি নীতির ফলে অতিষ্ঠ, তারাও ভারতের জবাব বা উত্তর কি হবে তার দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল। ভারত বেজিংয়ের হুমকি-ধমকির কাছে মাথা নোয়ায় কিনা সেই প্রশ্ন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নেতাদের মুখে মুখে ঘুরেছে। কারণ তারা চাইছিল ভারত রুখে দাঁড়াক এবং তাদের সাহস যোগাক। মোদি ঠিক সেটাই করে দেখালেন এবং সারা বিশ্বকে চমকে দিলেন। তিনি প্রমাণ করলেন ভারত চীনের সমকক্ষ না হলেও প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ফলে তিনি চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে শুধু পরাস্তই করলেন না, ভুটানের সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা অক্ষত রাখলেন। ফলে ভুটানের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখার জন্য ভারতের দায়বদ্ধতা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। যে কারণে বেজিং ভারতের ওপর রেগে অগ্নিশর্মা ও দিশেহারা হয়ে পড়ে সব ধরনের শোভনতা বর্জন করে লাগামহীনভাবে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে। এমনকি ভারতের বাপ-বাপান্ত করতেও ছাড়েনি। চীনের বর্তমান সংস্কৃতি যে কত নিম্নস্তরের তার পরিচয় পাওয়া যায় এক সরকারী মুখপাত্রের বক্তব্য থেকে। ওই মুখপাত্রটি বলেন, ‘ভারতীয় সৈন্য ডোকলামে ঢুকে আমাদের বাহিনীর সঙ্গে যে অভব্য আচরণ করেছে তার জন্য আমরা ভারতীয়দের এমন শিক্ষা দেব যে, তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের কথাও ভুলে যাবে।’ আসলে মোদি চীনকে এশিয়ার একমাত্র অধিপতি হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশে বেজিংয়ের আধিপত্যবাদের নীতি মোদি সরকার কোনভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। ফলে ওই সম্প্রসারণবাদী নীতিকে প্রতিরোধ করার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করছেন মোদি। সেই কারণে বেজিং বেজায় চটেছে। এক চীনা ভাষ্যকার লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাক্রমশালী দেশ যখন এশিয়ায় আমাদের সমীহ করে চলে এবং আমাদের প্রতিরোধ করার দুঃসাহস দেখায় না তখন ভারতের মতো এক দুর্বল দেশ চীনের কাছে নতি স্বীকার না করে, ডোকলাম যে চীনের অংশ তা অস্বীকার করে ভুটানের ত্রাতা সাজার চেষ্টা করে কোন্ সাহসে?’ এই মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার প্রধানমন্ত্রী মোদি চীনের দর্পকে কিভাবে এক বিশাল ধাক্কা দিয়েছেন। আর সেই ধাক্কা চীন কোনভাবেই হজম করতে পারেনি বলে ভারতের বিরুদ্ধে চরম কুরুচিকর প্রচার চালায়। যেহেতু আমাদের সাহসী সেনারা ডোকলামে বুক চিতিয়ে খালি হাতে চীনের লাল ফৌজকে নাস্তানাবুদ করার স্পর্ধা দেখিয়ে ভুটান ভূখ-ে তাদের ঢুকতে বাধা দেয়, সেই কারণে চীনের টিভি পর্দায় দেখা যায় শিখদের নিয়ে নানা ঠাট্টা-তামাশার প্রোগ্রাম। চীনা মেয়েরা মুখে নকল দাড়ি এবং মাথায় পাগড়ি পরে নানা ভাঁড়ামি ও রুচিহীন প্রোগ্রাম দেখায়। নিম্ন রুচির এসব কাজ করেও চীনারা ক্ষান্ত থাকে না। তার সঙ্গে সরকারী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকেও ‘আসন্ন চীন-ভারত যুদ্ধের জন্য’ নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়। এমন সব কথা ও লেখা ছাপা হয় যে, ‘চীনের আপামর জনসাধারণ চাইছে তাদের লাল ফৌজ ভারতকে এমন শিক্ষা দিক যাতে দেশটির শিরদাঁড়া ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় এবং দেশটি ভবিষ্যতে যাতে আর উঠে দাঁড়াতে না পারে।’ চীনা মিডিয়ায় বলা হলো ‘ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার এবং সেই যুদ্ধে ভারতের হার হবে ১৯৬২-এর চেয়ে অনেক বেশি অপমানজনক।’ চীনের এত প্ররোচনা সত্ত্বেও মোদি সরকার ধীরস্থির ও শান্ত থেকেছে, যা বিশ্বজুড়ে খুবই প্রশংসিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ডোকলাম নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। বরং তাঁর বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে দিয়ে মাত্র দুটি বিবৃতি দেওয়ান, যাতে তিনি যুদ্ধ নয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি চীনকে মনে করিয়ে দেন ‘দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বলবত আছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বা চীন একতরফাভাবে সীমান্তের বর্তমান অবস্থা পাল্টাতে পারবে না। চীন যুদ্ধংদ্রেহী মনোভাব দেখিয়ে ভুল করছে। যুদ্ধ হলে দুই দেশেরই ক্ষতি হবে, কিন্তু চীনের ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক বেশি।’ চীন প্রত্যুত্তরে বলে আলাপ-আলোচনার সময় পেরিয়ে গেছে। আর আলোচনা তখনই হতে পারে যখন ভারত তার সৈন্য ডোকলাম থেকে প্রত্যাহার করবে। চীন কোনমতেই ডোকলাম থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেবে না বলে ঘোষণা করে। চীনের এই আধিপত্যবাদের মনোভাব আন্তর্জাতিক স্তরে সমালোচিত হয় এবং নিন্দার ঝড় তোলে। আমেরিকা ও জাপান সরকারীভাবে বিবৃতি দিয়ে ডোকলামে বেজিংয়ের আধিপত্যবাদের নীতিকে কড়া ভাষায় নিন্দা করে। রাশিয়াও চীনের অবস্থানকে ‘অযৌক্তিক’ বলে আখ্যায়িত করে। ইরানের মতো একটি দেশও চীনকে তার সৈন্য প্রত্যাহার এবং ত্রিদেশীয় সীমান্তে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানায়। জাপান মোদির ভূমিকাকে ‘অত্যন্ত সংযত ও মার্জিত’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করে। জাপানের মনোভাব ছিল সবচেয়ে কড়া ও স্পষ্টভাষিতায় ভরা। জাপানের মত হলো ‘ভুটানের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে ভয় দেখিয়ে তার ভূখ- জবর-দখল করার পাঁয়তারা ভারত যেভাবে ভেস্তে দেয় তার জন্য ভারতকে সাধুবাদ জানানো উচিত।’ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বেজিং দিল্লীর চালে ক্রমশ একঘরে হচ্ছে এবং বিশ্বের জনমত যে ক্রমশ তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে তা চীন বুঝতে পারে বেশ দেরিতে। কিন্তু যে সম্ভাবনা চীনকে খুবই আতঙ্কিত করে তোলে তা হলো- জিয়ামেনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন যদি মোদি বয়কট করেন তাহলে পাঁচ দেশীয় সম্মেলনটি শুধু গুরুত্বহীনই হয়ে পড়বে না, ওই জোট ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। আর তার দায়-দায়িত্ব চীনের ওপরই বর্তাবে। চীনের আরও অনেক ভয়ের কারণ ছিল। যার মধ্যে অন্যতম হলো : ভারত যদি চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে তাহলে বেজিং ভারতের বিশাল বাজার হারাবে, যার ধাক্কা চীনের অর্থনীতির ওপর পড়বে। এমনিতে জাপান প্রযুক্তি যেভাবে ভারতের বাজার দখল করছে তা চীনের জন্য অশনিসঙ্কেত। যেমন চীনের বুলেট ট্রেনের প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারত এ ব্যাপারে জাপানি প্রযুক্তিকেই বেছে নিয়েছে। ভারতীয় রেলকে জাপান তার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঢেলে সাজাতে চলেছে। তাছাড়া আসন্ন ১৯তম চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসেও প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হতো। যে কারণে দলের ও দেশের নেতৃত্ব বদলও হতে পারত। সুতরাং অবস্থা বেগতিক বুঝে চীন ভারতের আপোসরফায় সম্মত হয়। মাত্র তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর চীন ভারতের প্রস্তাবিত সমাধান সূত্র মেনে ডোকলাম থেকে সেনা প্রত্যাহারে রাজি হয়। ডোকলাম অভিজ্ঞতা থেকে ভারত অনেক কিছু শিখেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় ব্যাপারটি হলো ভারত চীনের কাছে মাথা না নুইয়ে তার হৃত আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা ফিরে পেয়েছে। এশিয়ায় চীনের তুলনা শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো চীনকে কখনও বিশ্বাস না করা এবং দেশটিকে বন্ধু দেশ হিসেবে গণ্য না করা। বেজিং দিল্লীকে সব সময় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু দেশ বলে ভাবে। ভারতকে সর্বতোভাবে দুর্বল করে খ-িত করাই হলো তার মূল লক্ষ্য। শি জি পিং যতই মুখে মোদিকে আশ্বাস দিন ‘ভবিষ্যতে ডোকলামের পুনরাবৃত্তি হবে না’ তবু চীনকে বিশ্বাস নেই। কারণ ভারত চীনের আঁতে যেভাবে ঘা দিয়েছে তা চীন কোনদিনই ভুলবে না। সময়-সুযোগের জন্য অপেক্ষা করে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। সুতরাং ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ চীন হলো এক নয়া সম্প্রসারণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। ব্রিটিশদের মতো চীনারাও কখনও চতুরতা, আবার কখনও যুদ্ধের মাধ্যমে বিদেশী ভূখ- গ্রাস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে বদ্ধপরিকর। এটাই এখন কমিউনিস্ট চীনের আন্তর্জাতিক পরিচয়। লেখক : ভারতীয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
×