ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা জব্বর

একুশ শতক ॥ খবর নেই ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ খবর নেই ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের

আগের দুই কিস্তিতে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি শেষ কিস্তি। এতে আমরা উপসংহারে পৌঁছাচ্ছি। ॥ তিন ॥ সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ব্যয়ও প্রণীত হয়েছে। এতে ব্যয়ের খাত প্রস্তাবিত ব্যয় হচ্ছে নিম্নরূপ : অফিসারদের বেতন ৬৫.১০ লাখ টাকা, স্টাফদের বেতন ১৩.২৩ লাখ টাকা, প্রকল্প পরিচালকের অফিস ভাড়া ২১.০০ লাখ টাকা, জ্বালানি, গ্যাস ও লুব্রিকেন্টস ২০.০০ লাখ টাকা, প্রিন্টিং এ্যান্ড স্টেশনারী ২০.০০ লাখ টাকা, কনসালটেন্সি ১০.০০ কোটি টাকা, অপারেটিং ব্যয় ৪০.৬৭ লাখ টাকা, যানবাহন (জীপ ও মাইক্রোবাস) ১ কোটি টাকা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ১০ কোটি টাকা, কম্পিউটার এক্সেসরিজ ১০ কোটি টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যার ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা, অফিস যন্ত্রপাতি ২০.০০ লাখ টাকা, আসবাবপত্র ৫ কোটি টাকা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ (পিএবিএক্স) ৫০.০০ লাখ টাকা, ইলেকট্রিক সাব স্টেশন ও বহিঃবিদ্যুতায়ন ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ভূমি অধিগ্রহণ ৫০ কোটি টাকা, ভূমি উন্নয়ন ১৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, প্রশাসনিক ভবন ৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, ছাত্র হলো ৩২ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ছাত্রী হলো ৩৫ কোটি টাকা, ভিসির বাসভবন ৩ কোটি টাকা শিক্ষক-কর্মচারী ডরমিটরি ১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা, অধ্যাপকের কোয়ার্টার ১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা, স্টাফ কোয়ার্টার ১৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, গেস্ট হাউস ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, একাডেমিক ভবন ৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, লাইব্রেরী ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা, ইলেকট্রিক সাব স্টেশন ও পাম্প হাউস ৬০ লাখ টাকা, সোলার সিস্টেম ১১ কোটি টাকা, মসজিদ, ৬ কোটি ৯৭ লাখ, ক্যাফেটারিয়া ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা, ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র ৭ কোটি টাকা, মেডিক্যাল সেন্টার ৬ কোটি টাকা, মেইন গেট ৫০ লাখ টাকা, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মিনার ৮০ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ সড়ক ১ কোটি ১২ লাখ টাকা, ড্রেইন নির্মাণ ১ কোটি টাকা, গভীর নলকূপ ২ কোটি টাকা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ৫০ লাখ টাকা, প্রাচীর নির্মাণ ১ কোটি ৫ লাখ টাকা, পিজিক্যাল কন্টিজেন্সি ৪ কোটি টাকা, প্রাইস কন্টিজেন্সি ১০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ সভাটিতে প্রধানত খসড়া আইনটি নিয়ে আলোচনা হলেও আমার ধারণা মতে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শিক্ষার সব স্তরের ডিজিটাল কনটেন্টস তৈরির সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছি। একই সঙ্গে এই প্রস্তাবটিও করেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়টি কালিয়াকৈরের হাইটেক পার্কে যেন স্থাপন করা হয়। এর ফলে প্রকল্প ব্যয় ৬৫ কোটি টাকা কমার পাশাপাশি প্রয়োগ ক্ষেত্র হিসেবেও হাইটেক পার্ককে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। প্রকল্প ব্যয়ের তালিকা দেখে আমার এটিও মনে হয়েছে যে, এতে গবেষণা ও ডিজিটাল কনটেন্টস গড়ে তোলার বিষয়টি ভাবাই হয়নি। কম্পিউটার আর সফটওয়্যারের মাঝে সীমিত থাকার ফলে এটি ধারণাগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হবে না। ফলে প্রকল্প ব্যয় পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে। এসব ধারণা বুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনটি পাস হয়। কিন্তু এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর এক পাও সামনে যাননি। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন জরুরী : বাংলাদেশের প্রশাসনকে যারা চেনেন তারা এই কথাটি বলতেই পারেন যে বাংলাদেশে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন এতটা সহজ নয়। ২০১০ সালের প্রকল্পের জন্য ১৪ সালে খসড়া আইন হলে বা ১৬ সালের জুলাইতে আইন পাস হলেই ১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সেটির ছায়া কোথাও দেখা যাবে সেটাও আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। বরং এর মাঝে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন নামক একটি বস্তু যে পাওয়া গেছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ এবং অবশ্যই আমরা অপেক্ষায় আছি কবে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আলোর মুখ দেখবে তার জন্য। তবে আমার নিজের একটু ইচ্ছা আছে অন্তত এটুকু সবাইকে জানানো যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা খুবই জরুরী। প্রথমত যে কারণে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন খুবই জরুরী সেটি হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যুক্ত আছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের স্মরণ থাকার কথা যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় হবার কথা নয় এটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করারও কেন্দ্র হবার কথা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করার বিষয়টি যুক্ত নেই- তবুও এর মূল প্রস্তাবক হিসেবে আমাদের দাবিটা থেকেই গেল। আমি এখনও আশা রাখি, কোন না কোনভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করার একটি বিশাল কেন্দ্রে পরিণত হবে। সেজন্যই কাজটি যত দ্রুত হতে পারে ততোই মঙ্গলজনক। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি ডিজিটাল যুগের যে শিক্ষার স্বপ্ন দেখছে সেটি বিলম্বিত হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। বলা হতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের তো অভাব নেই। প্রকৌশল বিষয়ক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও অভাব নেই। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় একথা বলতে পারি যে, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ এর ডিজিটাল শিক্ষার যুগে উন্নীত করতে চাইছি। আমরা খুব সহজেই বুঝি যে, দুনিয়াটা এখন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-এর দিকে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও ৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। ২০০৩ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও একই প্রত্যয় ঘোষণা করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেমালুম ভুলে ছিলেন। অন্যদিকে আমরা ইন্টারনেটে খুঁজলে এমন তথ্য পাব যে- ওইসিডি-এর মতো প্রতিষ্ঠান বলেছে, Knowledge is now recognized as the driver of productivity and economic growth, leading to a new focus on the role of information, technology and learning in economic performance. আমি অবাক হইনি এটি দেখে যে ওইসিডি-এর মতো প্রতিষ্ঠানও শিক্ষা ও দক্ষতাকে দারুণভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তারা খুব সহজেই এটি অনুভব করছে যে প্রচলিত দক্ষতা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে কোন কাজে লাগবে না। Employment in the knowledge-based economy is characterized by increasing demand for more highly-skilled workers. The knowledge-intensive and high-technology parts of OECD economies tend to be the most dynamic in terms of output and employment growth. Changes in technology, and particularly the advent of information technologies, are making educated and skilled labour more valuable, and unskilled labor less so. Government policies will need more stress on upgrading human capital through promoting access to a range of skills, and especially the capacity to learn; enhancing the knowledge distribution power of the economy through collaborative networks and the diffusion of technology; and providing the enabling conditions for organizational change at the firm level to maximise the benefits of technology for productivity. আমি মনে করি, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে এমন প্রথম প্রতিষ্ঠান যেখানে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জন্য মানবসম্পদ তৈরি করবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল একটি সনাতনী ধারার বিশ্ববিদ্যালয় হবে না- হবে আমাদের ৪১ সালের স্বপ্ন পূরণের প্রধান কেন্দ্র। সেই কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যদি আমাদের জ্ঞানভিত্তিক সমাজের শিক্ষার প্রাথমিক রূপান্তরটি না করে তবে অন্যরা কেমন করে আমাদের পুরো দেশটাকে সামনে নিয়ে যাবে? বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জটুকুও আমরা ভুলতে পারি না। এখানকার পাঠ্য বিষয়, পাঠ্যক্রম ও পাঠদাতাদের যে স্তরটির কথা আমরা ভাবছি সেটি কি অতি সহজেই গড়ে তোলা সম্ভব হবে? ২০১০ সাল থেকে স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা এখনও তেমন কোন আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি না। গত ১৭ আগস্ট ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিষদের ২৪তম সভার কার্যবিবরণী থেকে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ অবস্থাটি কি? “২.১.৭ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গাজীপুর জেলায় ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আলোচনা : গাজীপুর জেলায় ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সভায় জানান যে, এ বিষয়ে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আইন, ২০১৬” ২৬ জুলাই ২০১৬ তারিখে জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি গাজীপুর হাইটেক পার্কে স্থাপনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে ৫০ একর জমি বরাদ্দ চাওয়া হলে হাইটেক পার্ক হতে বর্ণিত জমি বরাদ্দ করা হবে না মর্মে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। পরবর্তীতে হাইটেক পার্ক সংলগ্ন অব্যবহৃত ৫০ একর জমি খাস খতিয়ানে রিজিউম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে কিন্তু কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আইসিটি বিশেষজ্ঞ জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক পূর্বেই ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা প্রদান করেছেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের কাজ ঠিক গতিতে এগুচ্ছে না, কোথাও সমস্যা আছে। তিনি বলেন যেহেতু স্থান জটিলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও স্থাপিত হয়নি, সেক্ষেত্রে উপাচার্য নিয়োগপূর্বক অস্থায়ী কোন ক্যাম্পাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান। সিদ্ধান্ত : ১. ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ এর উপাচার্য নিয়োগপূর্বক অস্থায়ী কোন ক্যাম্পাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ২. গাজীপুর জেলা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাস্তবায়নে: সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।’ আমি মনে করি, এরই মাঝে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারতেন। এমনকি তারা ঢাকা শহরে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পাসও চালু করতে পারতেন। দুয়েকটি বিষয়ও চালু করা যেত। আমরা ঠিক অনুধাবন করতে পারি না যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কোন উদ্যোগ কেন নিতে পারেনি। দৃশ্যমান হচ্ছে যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনাগ্রহ ছাড়া একে আর কোন শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
×