ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকের ব্যতিক্রমী ব্রত

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শিক্ষকের ব্যতিক্রমী ব্রত

একজন সত্যিকারের শিক্ষকই শিক্ষার মর্যাদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, শিক্ষার আলো ছড়ানোর ভূমিকাটি পালন করে যাবেন। প্রথাগত উপায়ে তো সেটা করাই যায়, কিন্তু অপ্রচলিত উপায়ে এবং সমাজের তথাকথিত মান-সম্মানের তোয়াক্কা না করে অন্যের ভেতর জ্ঞানের আলো ছড়ানো এবং জ্ঞান পিপাসা বাড়ানোর কাজ যিনি করেন, তাকে ব্যতিক্রমী বলতেই হবে। এমন একজন সাবেক শিক্ষককে নিয়ে খবরের কাগজে যে ফিচার ছাপা হয়েছে সেটি বহু শিক্ষিত ব্যক্তিরই চোখ খুলে দেবে। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার এই ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গির মানুষটির নাম ইসাহাক শরিফ। টানা ৩৫ বছর তিনি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নেয়ার পর এখন তিনি পরিচিত হকার হিসেবে! এই পরিচিতিতে আনন্দ পান তিনি। এক বছর ধরে অবসরপ্রাপ্ত এই কলেজশিক্ষক প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংবাদপত্র বিলি করেন। এ নিয়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের মধ্যে ছিল তীব্র আপত্তি। বিদ্রƒপও করেছেন অনেকে। কিন্তু এই কলেজশিক্ষক সবকিছু তুচ্ছ করে কাজটি করেই চলেছেন। উচ্চশিক্ষিত হয়েও অবসর জীবনে হকারের বৃত্তিকে বেছে নেয়ার কারণে প্রতিদিনই তাকে মানুষের কৌতূহলী জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার সাফ জবাব ‘অর্থের জন্য এটা করি তা নয়। এখানে বড় ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আমার যে দায়িত্ব তা কতটুকু করতে পারছি আমি। সংবাদপত্র হলো সমাজের আয়না। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনকার হালনাগাদ তথ্য মানুষের জানা উচিত। এতে মানসিক সুস্থতা আসে, সামাজিক স্থিরতা আসে। জ্ঞান শুধু বইয়ের মধ্যে নয়, জ্ঞান ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। এ জন্যই দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দিই।’ সমাজে প্রতিটি কাজই যে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে ছোট আর বড় বলে কোন কাজ থাকতে পারে নাÑ এই ব্যতিক্রমী মানুষটি সমাজের মানুষের কাছে সে তাৎপর্যপূর্ণ সত্যটি নতুন করে উপস্থিত করেছেন। কোন কাজই তুচ্ছ হতে পারে না, সকল কর্মীরই যথাযথ সম্মান প্রাপ্য। সততার সঙ্গে সম্পাদিত কোন কাজ বা কর্তব্যকর্মের জন্য কাউকে অসম্মান করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণও কাক্সিক্ষত নয়। ইসাহাক শরিফ যথার্থই অনুধাবনে সক্ষম হয়েছেন যে, পাঠে মনোযোগী হলে নবীনরা বিভ্রান্ত হবে না, মাদক ও অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। পত্রিকায় ভাল-মন্দ সব খবর আছে। এতে ভাল-মন্দের তফাতটা বুঝতে পারে মানুষ। আমাদের সমাজ ও চিন্তাকে সুস্থির, সাবলীল ও ইতিবাচক করতে হলে জ্ঞান ও তথ্যের বিকল্প নেই। তিনি সামাজিক মানুষের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে উচ্চ আসন দিয়েছেন। মানুষ যে পেশায়ই থাকুক না কেন, তার বয়স যাই হোক না কেন, সমাজের প্রতি তার একটি কর্তব্য রয়েছে। সচেতন ব্যক্তি সেই দায়িত্বটুকু যেমন নিজে পালন করেন, তেমনি তার কাজ সমাজের আর দশজনকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করা। এই শিক্ষকের পরম ব্রতটি সমাজে নিঃশব্দ আলোড়ন তোলার মতোই। সংশ্লিষ্ট এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি তার শিক্ষককে পত্রিকা বিলির মতো একটি কাজে মোটেও দেখতে চাননি। বিরত করারও চেষ্টা চালান। পরে তার বোধোদয় ঘটে। এখন স্যারকে নিয়ে তারা গর্ব করেন। এমন সাদামনের মানুষেরা আসলেই যে দেশের সম্পদ- সেটা অনুধাবনে সক্ষম হয়েছেন। ইসাহাক শরিফ সাংবাদিকের কাছে তার আকাক্সক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন যেটি আমাদের একজন পলান সরকারের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়। তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার করতে চান। একটি যানবাহনে টেবিল-চেয়ার, বই-সংবাদপত্র থাকবে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে এই পাঠাগার জ্ঞান বিলাবে। এটাই এখন ওই আলোকিত ব্যক্তির বাকি জীবনের স্বপ্ন। আমরা আন্তরিকভাবে চাই, তার এই স্বপ্ন পূরণ হোক। একইভাবে এমন স্বপ্ন দেখুক সমাজের আরও অনেক চিত্তবান মানুষ।
×