ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘অবৈধ অভিবাসনের জন্য মিয়ানমার কোন লোভনীয় দেশ নয় ’

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘অবৈধ অভিবাসনের জন্য মিয়ানমার কোন লোভনীয় দেশ নয় ’

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মিয়ানমার এমন কোন উন্নত বা ধনী দেশ নয় যে, বাংলাদেশের মানুষ সুখী জীবনের আশায় অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সে দেশে বসবাস করতে থাকবে। দীর্ঘকালজুড়ে যে দেশে জাতিগত সংঘাত চলছে সেই মৃত্যু উপত্যকায় নতুন করে কে যাবে? রাখাইন প্রদেশে জাতিগত নিধনের শিকার সেই জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ বলুক আর বাঙালীই বলুক, তারা সে দেশেরই বাসিন্দা। বহুজাতিক একটি দেশে কি বাঙালী থাকতে পারে না? এমন অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতিতে। এদিকে, ‘প্রমাণ ছাড়া কাউকে ফিরিয়ে নেয়া হবে না’- মিয়ানমার সরকারের এমন সিদ্ধান্তের জবাবে রোহিঙ্গারা বলছে, আমরা যে বংশপরম্পরায় শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করে আসছি তার বহু প্রমাণ রয়েছে আমাদের কাছে। সরকার কত প্রমাণ চায়? মিয়ানমার সরকারের তৈরি করা ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর তালিকায় নেই রোহিঙ্গা শব্দটি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে হরণ করা হয় রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার। এর আগে ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে তাদের গোনা হয় বাঙালী হিসাবে। এখন সে দেশের সরকার বলছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রহণ করা হবে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে গায়ের জোরে। কিন্তু কোন দেশে শত শত বছর ধরে বাস করা একটি জাতির কাছে কোন প্রমাণই থাকবে না, এটা কেমনে হয়। আমরা প্রমাণ দিয়েই ঢুকতে চাই নিজের ভিটেবাড়িতে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোহিঙ্গা যুবক আমান উল্লাহ বলেন, ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলেও ২০১০ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গারা ভোট দিয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংবিধান সংক্রান্ত একটি নির্বাচনেও আমরা ভোট দিয়েছি। ওই তালিকায় নিশ্চয়ই আমাদের নাম আছে। আমাদের বাপ-দাদারা সে দেশের নাগরিক। তাদের অনেকে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন। এটা ইতিহাস। পূর্বপুরুষ নাগরিক ছিলেন বিধায় অনেক সরকারী নথিতে তাদের নামও রয়েছে। আমরা তো তাদেরই বংশধর। নাগরিকত্বের প্রমাণ কিভাবে দেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রোহিঙ্গা যুবক আমান উল্লাহ জানান, আমাদের সামাজিক স্বীকৃতি রয়েছে। আমাদের প্রতিটি পরিবারের কাছে আছে একটি করে কার্ড। সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্যদের গণনা করে। কেউ অন্যত্র বেড়াতে গেলে অথবা কেউ বেড়াতে এলে তার উল্লেখ থাকে ওই কার্ডে। আমাদের ভিটেবাড়ি এবং চাষের জমি রয়েছে। জায়গাজমির কাগজপত্রও আছে। দীর্ঘকালজুড়ে সরকারের নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র চলছে বলেই আমরা কার্ডসহ প্রমাণপত্রগুলো যতœসহকারে সংরক্ষণ করি। রাখাইন থেকে পালিয়ে এলেও এসব কাগজপত্র সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তাছাড়া বাংলাদেশেও আমাদের নিবন্ধন হচ্ছে জাতিসংঘের সংস্থার মাধ্যমে। এসবই প্রমাণ করবে যে, আমরা রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা। মিয়ানমারের ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়া হয়েছে ১৯৮২ সালে। তার মানে এর আগের তালিকায় নাম ছিল। মিয়ানমার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল রোহিঙ্গা নেতাদের। সরকারেও ছিল প্রতিনিধিত্ব। সরকারী-বেসরকারী চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও ছিল রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৮২ সালের পরের রোহিঙ্গারাও তো সেই শত শত বছর আগের পুরুষদেরই উত্তরাধিকার। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন অনুযায়ী বিশ্বের কোথাও বিভাজনের মাধ্যমে এক বা একাধিক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে জনগণের মধ্যে যে অংশে যাদের বসবাস তারা সেই স্বাধীন ভূখ-ের নাগরিক। সে হিসাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। তাদের রোহিঙ্গা কিংবা বাঙালী যা-ই অভিহিত করা হোক না কেন, তার নাগরিকত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। রোহিঙ্গা ছাড়াও সে দেশে ১৩৫ গোষ্ঠীর বসবাস। তাদেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা এবং সংস্কৃতি। তারা যদি নাগরিক হতে পারে তাহলে রোহিঙ্গারা নয় কেন? রোহিঙ্গাদের যদি বাঙালী হিসাবে অভিহিত করা হয়, তবে তারা সে দেশের বাঙালী। তাদের মধ্যে কোন সন্ত্রাসী থাকলে তারাও সে দেশের সন্ত্রাসী, বাংলাদেশের নয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, মিয়ানমার এমন কোন উন্নত দেশ নয় যে, বাংলাদেশী নাগরিকরা সুখের প্রত্যাশায় নাফ নদ পাড়ি দিয়ে সে দেশে বসবাস করবে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ওই দেশটি অতটা লোভনীয় নয়। বরং জীবনযাত্রার মান, নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ অধিকাংশ সূচকে বাংলাদেশই এগিয়ে। অবৈধ অভিবাসন ঘটে ধনী দেশে, সমমান কিংবা কম সুবিধার দেশে নয়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙালী বললেই তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অস্বীকার হয়ে যায় না। বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো মিয়ানমারও বহুজাতির দেশ। বর্মী সরকারের দাবি অনুযায়ী, অধিকারহারা এ জনগোষ্ঠী যদি রোহিঙ্গা না হয়ে বাঙালীও হয়ে থাকে তবে সে দেশের বাঙালী। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে তাদের এ দাবি ধোপে টিকবে না, এমনই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীকে নাগরিক অধিকার দিয়েই ফিরিয়ে নিতে হবে নিজভূমে।
×