ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

চলে গেলেন নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নিসর্গের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন নিবিড় সখ্য। আমৃত্যু ভালবেসেছিলেন বৃক্ষের সবুজ সজীবতা। চেয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে উঠুক মানুষের সহাবস্থান। সে প্রত্যাশায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ’। তাই তো বৃক্ষপ্রেমী মানুষটির নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘প্রকৃতিপুত্র’ কিংবা ‘নিসর্গসখা’। প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন সেই নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্র্মা। শুক্রবার ভোররাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই প্রকৃতিবিদ, লেখক ও শিক্ষক। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী দেবী শর্মা এবং ছেলে সুমিত্র শর্মা ও মেয়ে শ্রেয়সী শর্মাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষী। পরিবারের বরাত দিয়ে প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দ্বিজেন শর্মা বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা ছাড়াও ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। সর্বশেষ স্কয়ার হাসপাতালে তার কিডনি ডায়ালাইসিস চলছিল। এ অবস্থায় শুক্রবার ভোররাত তিনটা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটের মধ্যে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। দ্বিজেন শর্মাকে গত ২৩ জুলাই রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ২৯ জুলাই তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউতে) নেয়া হয়। সেখান থেকে বুধবার তাকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দ্বিজেন শর্মার শেষকৃত্য বিষয়ে তার স্ত্রী দেবী শর্মা জানান, বর্তমানে তার শবদেহ রাখা হয়েছে স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে। শেষকৃত্যের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা লন্ডন থেকে ফিরে এলে তার শেষকৃত্য কোথায় হবে, তা চূড়ান্ত করা হবে। বাংলা একাডেমি ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে তিনি সংবাদকর্মীদের বলেন, কিডনি ফেইলর, ফুসফুসে পানি জমে যাওয়া এবং পরবর্তীতে মাল্টিপল অর্গ্যান ফেইলরে মারা গেছেন দ্বিজেন শর্মা। জীবনসঙ্গীর স্বপ্ন ও কর্ম নিয়ে দেবী শর্মা বলেন, বিগত প্রায় ৬০ বছরে আমরা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত ছিলাম। ছিলাম তার সব ভাবনাচিন্তাতেও। কেবল আপনজন হিসেবে নয়, এক ভিন্ন মানুষ হিসেবে দেখলেও বলব, তিনি এক পবিত্র সাত্ত্বিক জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি পুরো ঢাকার বিভিন্ন এভিনিউ কৃষ্ণচূড়া, পলাশ ও রাধাচূড়াসহ আরও অনেক ফুল বৃক্ষে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পুরো ঢাকা হবে গার্ডেন সিটি। দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুর খবর পেয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডের ক্রিস্টাল গার্ডেনের বাসভবনে ছুটে আসেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিশুসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক, কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব কুমার সাহা, অধ্যাপক সুশান্ত কুমার সরকার, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন ও মুকিত মজুমদার বাবু প্রমুখ। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, শুধুমাত্র প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি নয়, তিনি তরুণদের পরিবেশপ্রেমী হিসেবে গড়ে তুলতে এক সংগঠক হিসেবে কাজ করে গেছেন। তার অনুসারীর সংখ্যা এখন বিশাল। আমার মনে হয়, তার অসমাপ্ত কাজগুলো এখন ওরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রকৃতি বা বাংলার লোকজ ঐতিহ্য নিয়ে তার লেখা বিভিন্ন রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯২৯ সালের ২৯ মে তিনি সিলেটের বড়লেখা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিজেন শর্মা। বাবার নাম চন্দ্রকান্ত শর্মা ও মা মৌলভীবাজারের মগ্নময়ী দেবী। তিনি ১৯৪৭ সালে মাধ্যমিক, ১৯৪৯ সালে আগরতলার মহারাজা বীরবিক্রম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি নটর ডেম কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ ও সরকারী বাংলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার মস্কোতে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগ করেন। ১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন দ্বিজেন শর্মা। সংসার জীবনে আসে তাদের দুই সন্তান। ছেলে সুমিত্র শর্মা ও মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগের কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসও করতে হয়েছে দ্বিজেন শর্মাকে। ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। দ্বিজেন শর্মা রাজধানীর অসংখ্য জায়গায় তিনি গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য লড়াইও করেছেন তিনি। ক্লান্তিহীনভাবে মানুষকে গাছ চেনানোর পাশাপাশি বৃক্ষের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত করেছেন সকলের অন্তরে। কর্মময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে একুশে পদক পেয়েছেন দ্বিজেন শর্মা। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পদক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন পরিবেশ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখা তার আকরগ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘চার্লস ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘ডারউইন : বিগল যাত্রীর ভ্রমণকথা’, ‘নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘বাংলার বৃক্ষ’, ‘আমার একাত্তর ও অন্যান্য’, ‘প্রকৃতিমঙ্গল’, ‘বৃক্ষ ও বালিকা গল্প’ ইত্যাদি। এছাড়াও দেড় যুগ মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের কাজের সময় পঞ্চাশটির মতো বই অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন।
×