ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখার কৌশল

দাবি-দাওয়ার লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে ইসিতে যাচ্ছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দাবি-দাওয়ার লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে ইসিতে যাচ্ছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে দাবি দাওয়ার লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে সংলাপ করতে ইসিতে যাচ্ছে দলটি। ১২ অক্টোবর সংলাপকালে লিখিতভাবে এ দাবি দাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতে তুলে ধরার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার কাছেও তুলে ধরবে তারা। সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে বিএনপি যেসব দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে তার মধ্যে রয়েছে তফসিল ঘোষণার আগেই স্বাভাবিক নিয়মে রাজনৈতিক কর্মকা-ের সুযোগ প্রদান করা, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা, নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সবার জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েন করা, সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত সব কর্মকর্তাকে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা প্রদান, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের ভোট গ্রহণের কাজে নিয়োজিত না করা, রাজনৈতিক দলের নেতাদের মামলার নামে হয়রানি না করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ অর্থাৎ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সেভাবে সীমানা নির্ধারণ করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা, নির্বাচনের অন্তত এক মাস আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সব স্তরে রদবদল করা, আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন, ভোট কেন্দ্রে সব প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্য ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অবাধ সুযোগ রাখা, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ না করা ও প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের পর ফলাফল ঘোষণা করে প্রিসাইডিং অফিসার স্বাক্ষরিত ফলাফল সিট প্রার্থীদের সরবরাহ করা। সূত্র মতে, নির্বাচন কমিশনে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন সাবেক আমলা, বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও এদল সমর্থক ক’জন বুদ্ধিজীবী মিলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কি কি প্রস্তাব বা দাবি-দাওয়া নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া যায় তা তৈরি করছেন। এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করার আগে তারা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। এ বিষয়ে লন্ডন সফরে গিয়ে ছেলে তারেক রহমানেরও মতামত নিয়েছেন খালেদা জিয়া। জানা যায়, পূর্ব ঘোষণা অনুসারে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবেন। অবশ্য এর আগে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণার সময়ও খালেদা জিয়া সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি গাইড লাইন দিয়েছেন। তবে বিএনপি যতই বলুক নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিটি শেষ পর্যন্ত আদায় নাও হতে পারে এমনটি ভেবেই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় সে জন্যই দলীয় প্রস্তাবগুলো তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে দেয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে মিডিয়ার সামনেও তুলে ধরা হবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, যেসব দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেসব দেশের নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিভাবে কাজ করে সেসব তথ্য আগেই বিএনপি সংগ্রহ করেছে। আর এসব তথ্য পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেগুলো প্রযোজ্য সেগুলো প্রস্তাবে রাখা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৩ মে নির্বাচনী রোডম্যাপের খসড়া প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। খসড়া রোডম্যাপে রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ, আইন সংস্কার, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোট কেন্দ্র নির্ধারণ এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫ জুলাই থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করা হয়েছে। শীঘ্রই ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শেষ হবে বলে জানা যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৬ জুলাই চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত রোডম্যাপ অনুসারে ইতোমধ্যেই সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ২৪ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সংলাপ শুরু করেছে। তবে বিএনপির সঙ্গে ১২ অক্টোবর ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৬ অক্টোবর সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সবার সঙ্গে সংলাপ শেষে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সব প্রস্তাব পাওয়া যাবে তা ১৮ নবেম্বর খসড়া হিসেবে এবং ১৮ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। প্রসঙ্গত সংবিধান অনুসারে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবরের পর শুরু হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা। তাই নির্বাচনের খুব বেশি সময় বাকি নেই ধরে নিয়েই যাবতীয় প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপি মনে করছে নির্বাচন কমিশন মোটামোটি নিরপেক্ষ থাকলেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল ভাল ফল করবে। তবে দলের কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর মামলা থাকায় তাদের শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয় কিনা এমন আশঙ্কা আছে। অবশ্য এ জন্য দলীয় হাইকমান্ডের আগাম প্রস্তুতিও রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটি কৌশলও গ্রহণ করা হয়েছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের সময় প্রতিটি সংসদীয় এলাকা থেকে তিনটি নাম রাখা হয়েছে। কোন কারণে ১ নম্বরে থাকা ব্যক্তি নির্বাচন করতে না পারলে যাতে ২ নম্বরে থাকা লোকটি নির্বাচন করতে পারে। আর ২ নম্বরে থাকা ব্যক্তিও যদি নির্বাচন করতে না পারেন তাহলে যেন ৩ নম্বরে থাকা ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারেন। তবে এ ধরনের কোন সমস্যায় যাতে পড়তে না হয় সে জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপকালে রাজনৈতিক মামলায় কোন বিএনপি নেতাকে নির্বাচনের সময় যাতে হয়রানি না করা হয় সে ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এর আগে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকালেও বিএনপি দলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরে। ওই সংলাপকালে রাষ্ট্রপতির কাছে বিএনপির দেয়া পাঁচটি নামের মধ্যে ৫ সদস্যের বর্তমান নির্বাচন কমিশনে একজনকে রাখা হয়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে আপত্তি থাকায় বিএনপি এই কমিশনকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। তবে এক পর্যায়ে এই কমিশনকে মেনে নেয় তারা। ইতোমধ্যে বিএনপির প্রতিনিধি দল কয়েক দফা বৈঠকও করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপকালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড। আর এ জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা আমরা সংলাপকালে নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবে বলেন জন্য আর দাবি-দাওয়া বলেন তা আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপকালে তুলে ধরব। দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই এসব প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সংলাপে গিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কমিশনের কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরবেন।
×