রাজন ভট্টাচার্য ॥ চলতি বছর অতিবৃষ্টি আর বন্যায় সড়ক ও মহাসড়কের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীন এসব সড়ক-মহাসড়কের (সওজ) মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে একক জেলা হিসেবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত জামালপুর। কোন্ সড়কের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এর আর্থিক পরিমাণও ইতোমধ্যে নির্ধারণ করেছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। মাঠপর্যায় থেকে সওজের প্রকৌশলীদের পাঠানো তথ্য থেকে ক্ষতির আর্থিক হিসাব পাওয়া গেছে। তবে এখনও সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি, সিটি কর্পোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের হিসাব চূড়ান্ত হয়নি।
সড়ক বিভাগ বলছে, বানের পানির তোড়ে ৩৯ জেলায় প্রায় ১ হাজার ১৭৭ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও এই হিসাব ছিল বন্যা শুরুর পর পরই। এরপর বন্যা দীর্ঘ হওয়া ও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ক্ষতি বেড়েছে অনেক বেশি।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৩৯ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাল অবস্থায় রয়েছে। ৩৭ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙ্গাচোরা, ২৪ শতাংশ সড়ক মোটামুটি চলনসই। তবে এরমধ্যে কিছু অংশে হালকা বা ভারি মেরামত প্রয়োজন। বাকি সড়ক পুনঃনির্মাণ করতে হবে। সওজের ১০টি জোনের জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থা ঢাকা ও রংপুরের। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কুমিল্লা ও খুলনার। এর বাইরে রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, গোপালগঞ্জ ও কুমিল্লা জোনের সড়কের বড় অংশই মোটামুটি ভাল অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলেও জানা গেছে।
একাধিক প্রকৌশলী জানান, ইতোমধ্যে বেশিরভাগ সড়কের পানি নেমে গেছে। এখন সড়ক সংস্কার করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকারের কাছে আর্থিক প্রয়োজনীয়তার বিষয় উল্লেখ করে চিঠি দিতে যাচ্ছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের সড়ক বিভাগের অধীন ২১ হাজার ৩০২ দশমিক আট কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এরমধ্যে ৯৬টি জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৮১২ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ চার হাজার ২৪৬ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার। ৬৫৪টি জেলা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার। এছাড়া ব্রিজের সংখ্যা ৪ হাজার ৫০৭টি। কালভার্ট রয়েছে ১৩ হাজার ৭৫১টি।
সড়কের ক্ষতির বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বন্যায় সড়কের ক্ষতির আর্থিক হিসাব করা হচ্ছে। এখনও ওই হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। সুতরাং সড়ক মেরামতে আর্থিক সঙ্কট হবে না। তিনি বলেন, যেসব পয়েন্টে সড়ক ওয়াশ আউট হয়ে গিয়েছিল, তার বেশিরভাগই মেরামত করা হয়েছে। কিছু পয়েন্ট এখনও বাকি আছে। এ ছাড়া সড়ক মেরামতের কাজ দ্রুত চলছে।
১০ জোনেই সড়কের ক্ষতি ॥ দেশে ৬৪টি জেলাকে ১০টি জোনে ভাগ করে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে সওজ। এর মধ্যে ৭টি জোনের অধীনস্থ সড়কের ক্ষতির হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, রাজশাহী জোনের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, রংপুর জোনে ৭১ কোটি ৪২ লাখ ও ঢাকা জোনে ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ জোনে ১৯ কোটি ৮৮ লাখ, খুলনা ৬ কোটি ৫ লাখ, সিলেট ৩২ কোটি ও গোপালগঞ্জ জোনে ৭২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বাকি তিনটি জোন থেকে ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি। সেগুলো হচ্ছে : কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত জোনের অধীনে ৩৩টি জেলার সড়কের ক্ষতির হিসাব নিয়ে উপরোক্ত টাকার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো : সিলেট, সুনামগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, যশোর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, ভোলা, বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নবাবগঞ্জ ও গাইবান্ধা।
জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার ১৫টি সড়কে এক শ’ কিলোমিটারের বেশি সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক মেরামতে ২০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী। একইভাবে মানিকগঞ্জ জেলার ৮টি সড়ক মেরামতে প্রয়োজন ৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া জামালপুরের ৭টি সড়ক মেরামতে ৯ কোটি ৫ লাখ, শেরপুর ২ কোটি ৩৬ লাখ, যশোর ৬ কোটি ৫ লাখ, ফরিদপুর ৩৪ কোটি, মাদারীপুর ১৬ কোটি, গোপালগঞ্জ ২০ কোটি ও রংপুর ১২ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব দিয়েছে। একইভাবে অন্য জেলাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের নাম, স্থান ও ক্ষতির পরিমাণ জানিয়েছে।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩৯ জেলার এক হাজার ১৭৭ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত এসব জেলা থেকেই ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ সড়ক ভবনে পাঠিয়েছেন কর্তব্যরত প্রকৌশলীরা। ঈদের আগে সড়ক যান চলাচলের উপযোগী রাখতে গত সপ্তাহে ৬৪টি জেলায় ৮৩ কোটি টাকা অর্থ ছাড় করেছে সওজ। এর মধ্যে ২১ কোটি টাকা বিভাগীয় মেরামত (রুটিন) ও ৬২ কোটি টাকা মাইনর মেনটেনেন্স খাতে ব্যয় করার জন্য বলা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি অর্থবছরে সড়ক ও মহাসড়ক খাতে বাজেট রয়েছে ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩০২ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ওই বরাদ্দ থেকে এই প্রথম ৮৩ কোটি ছাড় করা হলো।
২১ জেলায় সাত হাজার কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত ॥ বন্যায় ২১টি জেলার ৭ হাজার ১৩০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঈদের আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) উপসচিব জি এম আব্দুল কাদের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, জামালপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জেলার ১ হাজার ১০৪ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
কাদের জানান, অন্যান্য জেলার মধ্য টাঙ্গাইলের ৯৯৭ কিলোমিটার, কুমিল্লার ৮৮০ কিলোমিটার, পঞ্চগড়ের ৮৫৮ কিলোমিটার, নীলফামারীতে ৫৩৬ কিলোমিটার রাস্তার ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতি ॥ দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩২ জেলার ১৯৯টি উপজেলা ও ৫১টি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়েছে। এতে ৩৭৮ কি.মি. বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত ও ৪৪৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাঙ্গামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা, শেরপুর জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ এই দফায় বন্যার কবলে পড়েছে।