ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোহ সৃষ্টি করেছে ভার্চুয়াল দুনিয়া

শিশুরা খুঁজে পেয়েছে আরেক জগত সময় কাটে ট্যাবে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শিশুরা খুঁজে পেয়েছে আরেক জগত সময় কাটে ট্যাবে

সমুদ্র হক স্কুলে খেলার মাঠ নেই। কোথায় খেলবে! কেউ কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায় না। সমবয়সীদের সঙ্গে কোথায় ছুটোছুটি করবে! দাদু-নানু, স্বজনরা কাছে নেই। বেড়াতেও আসে না। কার কাছে গল্প শুনবে, দুষ্টুমি করবে। অপার মমত্বের বায়না ধরবে। কখনও বাবা, কখনও মা-বাবা দুজনই অফিসে যায়। কাজের বুয়া আর কতক্ষণই থাকে। আর থাকলেই বা কি! এমন একাকীত্বে করবে টা কী! এসব শিশু-কিশোর নিজেরাই খুঁজে পেয়েছে আরেক জগত। দিন দিন ভার্চুয়াল বা ই-পর্দা তাদের কাছে টেনে নিয়েছে। বর্তমানে এদের ট্যাব-স্মার্টফোনের পর্দা এতটাই আকর্ষণ করে যে, সুযোগ পেতে হয় না। সুযোগ এসে ধরা দেয়। কিছুদিন আগেও শিশুরা ডেস্কটপে নানা ধরনের মজার খেলা খেলত। বলা হতো কম্পিউটার গেম। এখন কম্পিউটারের ওই বড় স্ক্রিন (মনিটর) কাছে টানে না। স্ক্রিন এখন ছোট হয়ে কম্পিউটার ট্যাবে এসেছে। সেলফোন (মোবাইল ফোন) সেট নির্মাতারা তিন থেকে সাত ইঞ্চি স্ক্রিনের সেলফোনের মধ্যে গোটা বিশ্বকে তুলে ধরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শিশু মনোস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে মজার সব এ্যাপ্লিকেশন (এ্যাপ) ধারণের ব্যবস্থা করেছে। আট গিগাবাইট (জিবি) থেকে এক শ’ আটাশ জিবি পরিমাপের ধারণক্ষমতা আছে ওই সব সেটে। ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে র‌্যানডম এ্যাকসেস মোমোরি (র‌্যাম) দুই জিবি থেকে চার জিবি পর্যন্ত করা হয়েছে। এসব স্মার্টফোন ও ট্যাবের দাম কমেছে। দিন দিন আরও কমছে। বড় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাব ও স্মার্টফোনকে আরও সহজলভ্য করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় নগর জীবন ছাড়াও গ্রামীণ জীবনেও অনেকের ঘরে স্মার্টফোন পৌঁছেছে। নগর জীবনে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর শিশু-কিশোরদের হাতেও পৌঁছে গেছে ট্যাব ও স্মার্টফোন। অনেক সময় বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী চাকরিজীবী হওয়ায় তাদের সন্তানদের হাতে ট্যাব তুলে দেন। এ শিশু-কিশোররা ভার্চুয়াল জগতের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে যে, বেশিরভাগ সময় কাটায় ট্যাবের স্ক্রিনে। আসক্তিতেও পেয়ে বসছে অনেককে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জার্নাল ‘পেডিয়াট্রিক্সের’ এক জরিপে বলা হয়েছে, যেসব শিশু-কিশোর দিনের অনেকটা সময় টিভি দেখে, কম্পিউটারে গেম খেলে, ট্যাব ও স্মার্টফোনের পর্দার সামনে বসে- তারা মনোস্তাত্ত্বিকভাবে বেশি সমস্যার মধ্যে থাকে। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত করে। তাদের আচরণে পরিবর্তন আসে। (উল্লেখ্য, জাতিসংঘের শিশুর সংজ্ঞা অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি দেশে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু)। বর্তমান বিশ্বে ইলেক্ট্রনিক (ই) যন্ত্রপাতির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। শিশুদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরার প্রতি শিশুদের এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন অভিভাবক মনে করেন এভাবে শিশুরা স্মার্ট হচ্ছে (!)। এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ। তারা ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, যারা দিনে পাঁচ ঘণ্টা ভার্চুয়াল পর্দার সামনে বসে তাদের মেধার বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। যারা লেখাপড়ার পাশাপশি বাইরের জগত সম্পর্কে জানার জন্য অল্প সময় ট্যাবে বসে তাদের মেধার বিকাশে নানান মাত্রা যোগ হয়। গবেষকগণ পরামর্শ দিয়েছেন- শিশুরা অবশ্যই নতুন কিছু সম্পর্কে জানবে, জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে। পাশাপাশি শিশুদের থাকতে হবে প্রকৃতির মধ্যে। যেমন মাঠে খেলাধুলা, সমবয়সীদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া, কাছের মানুষ স্বজনদের সান্নিধ্য পাওয়া, পরিবারের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, নতুন কিছু দেখা ও শেখা। শিশুদের জন্য সময়গুলো এমনভাবে সাজানো দরকার যাতে প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাছে মধুর অভিজ্ঞতা হয়ে ধরা দেয়। এভাবে শিশুরা মানসিক এবং সামাজিকভাবে গড়ে ওঠে। একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, একবিংশ শতকের এ সময়টায় পৃথিবী এত দ্রুত চলছে যে, তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নিকট অতীতে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে একটা মধুর বন্ধন ছিল। তারও আগে ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বর্তমানে সবকিছু ভেঙ্গে গিয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে মা-বাবা ও সন্তানদের নিয়ে একেকটি পরিবার। জীবিকার প্রয়োজনে বাবাকে রোজগার করতে হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতে হয় বাইরে। কখনও বাবা-মা দুজনকেই চাকরি করতে হয়। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের আগমনও বেশি হয় না। কুটুম্বিতা (স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া) একেবারে কমে গেছে। এমন এক অবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠছে বর্তমানের শিশুরা। এর মধ্যেই এগিয়ে যাওয়া পৃথিবীতে হাতের মুঠোয় এখন ই-জগত বা ভার্চুয়াল জগত, যার বড় প্রভাব পড়েছে শিশু সাইকোলজিতে। বিশ্বে প্রতি শিশু এক শ’ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তিন বছরের মধ্যেই মেধার বিকাশ ঘটে ৮০ শতাংশ। পাঁচ বছরে ৯০ শতাংশ। ৮ বছরের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। বাকি ২ শতাংশ সারাজীবনে। এ আট বছর পর্যন্ত শিশুদের মেধা এতটাই তীক্ষè থাকে যে, দ্রুত সবকিছুই মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারে। এ ধারণক্ষমতা তাদের জীবনভর এগিয়ে দেয়। একজন সাইকোলজিস্ট বলেন, শিশুদের কখনও ‘না’ বলা উচিত নয়। তারা শিখবে। তবে তা যেন থাকে অতিসহনীয় মাত্রায়। একাডেমিক শিক্ষার পাশপাশি তাদের বাইরের জগত সম্পর্কেও জানতে হবে। তাদের বই পড়ার দিকে মনযোগী করে তোলা দরকার। খেয়াল রাখা দরকার, এই ট্যাব ও স্মার্টফোন যেন ছেলেবেলায়ই একাকীত্বে গ্রাস না করে। তারা যেন ইন্ট্রোভার্টের দিকে না যায়।
×