ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লোকজ গল্পের ব্যতিক্রমী চিত্রায়ন ‘সোনাবন্ধু’

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

লোকজ গল্পের ব্যতিক্রমী চিত্রায়ন ‘সোনাবন্ধু’

সাজু আহমেদ ॥ কে বলে আমাদের দেশে ভাল গল্পের চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না? অন্তত ‘সোনাবন্ধু’ চলচ্চিত্রটি দেখলে সে কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে রাজনীতি, মারামারি, ধর্ষণ, কূটকৌশল, একঘেয়েমি এবং আগে থেকে বলতে পারা গতানুগতিক গল্পনির্ভর চলচ্চিত্রের বাইরে এসে নতুন লোকজ গল্প ও গীতনির্ভর এক চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দিল শুভ টেলিফিল্ম। এ প্রযোজনার ব্যানারে এবারের ঈদ-উল-আযহায় মুক্তি পেয়েছে নতুন এবং ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র ‘সোনাবন্ধু’। চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ মাহাবুবা শাহরীন। পরিচালনা করেছেন জাহাঙ্গীর আলম সুমন। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরপরই বেশ আলোচনায় আসে। এ আলোচনার ফলশ্রুতিতে ঈদের দ্বিতীয় সপ্তাহেও বেশ ভাল চলেছে চলচ্চিত্রটি। ভাল গল্পের চলচ্চিত্র যে দর্শক দেখতে চায় তার প্রমাণ ‘সোনাবন্ধু’। চলচ্চিত্রের অন্যতম চারটি চমক দর্শকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট এবং উপভোগ্য করেছে। এগুলো হলোÑদুই প্রজন্মের শীর্ষ গ্লামারকন্যা, জনপ্রিয় দুই নায়িকা সাদিকা পারভীন পপি এবং পরিমনিকে এ চলচ্চিত্রে কাস্ট করা হয়েছে, যা চলচ্চিত্রের গল্পের সাবলীল উপস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি এ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনেতা ডি এ তায়েব ছোট পর্দার খোলস ভেঙ্গে বড় পর্দায় নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। চলচ্চিত্রে তার প্রাণবন্ত অভিনয় দর্শকদের বেশ মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন গানের দৃশ্যে তার অভিব্যক্তি তাকে পরিপূর্ণ অভিনেতার স্বীকৃতি দিয়েছে। আর সর্বশেষ চমক হলো ছোট পর্দার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সুমন এবং তার ব্যতিক্রমী গল্প নির্বাচন। ছোট পর্দার একজন জনপ্রিয় নায়ক বা অভিনেতাকে দিয়ে তিনি শুধু এক্সপেরিমেন্টই করেননি বরং অনেক সফলভাবেই তার কাজটি সম্পন্ন করেছেন। বলা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠিত এবং পরীক্ষিত নির্মাতাই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। সে অবস্থায় তিনি নির্দ্বিধায় ঝুঁকি নিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। ছোট পর্দার অভিনেতারাও যে চলচ্চিত্রে সুযোগ পেলে ভাল করতে পারেন তা প্রমাণ করেছেন ডি এ তায়েব। এছাড়া একাধিকবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী পপির অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। পাশাপাশি নতুন সাড়া জাগানো অভিনেত্রী পরিমনিও এ চলচ্চিত্রে তার সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্য অভিনয়শিল্পীরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভিনয় করতে। এছাড়া গল্পের চিত্রায়নে লোকেশন নির্বাচনেও নিপুণতার পরিচয় মিলেছে। এ চলচ্চিত্রের অন্যতম ভাললাগার বিষয় চিত্রগ্রহণ। খুবই ভাল লেগেছে চিত্রগ্রহণ। এছাড়া আরও কয়েকটি ভাললাগার মতো দৃশ্য সৃষ্টি করেছেন পরিচালক, যে দৃশ্যগুলোতে মুহুর্মুহু করতালি দিয়েছেন দর্শকরা। সব মিলিয়ে ‘সোনাবন্ধু’ চলচ্চিত্রটি আমাদের শিল্পাঙ্গনে নতুন একটি সফল প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ডি এ তায়েবকে বড় পর্দার হিরো হিসেবে আবিষ্কার করেছেন দর্শক। এজন্য পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সুমন সাধুবাদ পেতেই পারেন। অভিনেতা ডি এ তায়েব, অভিনেত্রী পপি, পরিমনি ও ঝুনা চৌধুরী, মাহমুদুল ইসলাম মিঠুসহ অন্যদরাও তাদের প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচিয়তা মাহবুবা শাহরীনকে অনেকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেয়া যায় শুভ টেলিফিল্মকে। তাদের উদ্যোগের কারণেই এমন একটি ভাল চলচ্চিত্র দর্শকরা উপহার পেয়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ দর্শকদের প্রত্যাশা এ রকম আরও ভাল গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নিয়মিতভাবে দেখতে চান তারা। তবে একটি ভাল ও সফল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার জন্য পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের কিছু বিষয়ে সচেতন থাকা বিশেষ প্রযোজন। চলচ্চিত্রে এ ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথেষ্ট ত্রুটি বেশ চোখে পড়েছে। বিশেষ করে গল্পের মাঝে কোথাও কোথাও গানের অতিরিক্ত ব্যবহার বেশ বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ গল্পের চিত্রায়নে মৌলিক গানই বেশি দাবি করে। এক্ষেত্রে প্রচলিত জনপ্রিয় গানগুলো চলচ্চিত্রে জুড়ে দিয়ে এর উজ্জ্বলতা হয়তো বেড়েছে কিন্তু মৌলিক কিছু সৃষ্টির যে জৌলুসতা তা অনেকটাই মøান হয়েছে। বাণিজ্যিক চিন্তা থেকেই একাধিক গান ব্যবহার করা হয়েছে, যেমনটি করা হয়েছে লামিয়া মিমোর ‘আমি ইলেক্ট্রা’ গানটি। এ গানটির ব্যবহার না করলে কি চলচ্চিত্রের গল্প উপস্থাপনায় বা নান্দনিকতায় কোন ছেদ পড়ত? বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়া চলচ্চিত্রের গল্পে নায়ক ডি এ তায়েব যখন তার গুরুর চিকিৎসার জন্য মেয়ের গয়না বিক্রির জন্য যাচ্ছিল তখন কেন পরিমনির সঙ্গে ডিএ তায়েবের গান ব্যবহার করা হলো তা বোধগম্য নয়। চলচ্চিত্রের শেষের দিকে ‘লিলুয়া বাতাসে’ গানটির ব্যবহার অহেতুক মনে হয়েছে। পাশাপাশি শেষের দিকে আরও দুটি গানের ব্যবহার দর্শকদের অহেতুক বসিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’ গানটি বিছানায় বসে গেয়েছেন ডি এ তায়েব। যেটি তিনি কথাচ্ছলে বাইরে গিয়েও বলতে পারতেন। এতে আবহটি আরও যৌক্তিক ও প্রাণবন্ত হতো। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের ব্যতিক্রমী গল্পটিকে গাঁথুনি এবং নির্মাণে অনেকটা দুর্বল মনে হয়েছে দুর্বল সম্পাদনার কারণে। এ রকম একটি ব্যতিক্রমী গল্পের চিত্রায়নের ক্ষেত্রে শিল্প নির্দেশনা আরও ভাল হতে পারত। এছাড়া শিল্পীদের মেকআপ আরও যুতসই হওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে নায়িকা পপিকে দু’-একটি দৃশ্যে তার মুখাবয়ব ও শরীরের অন্য অংশের মেকআপ একেবারেই আলাদা এবং দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। গ্রামের মেয়ের চরিত্রে পপির চুলের স্টাইল এবং পরিচ্ছদে আরেকটু গ্রাম্যতা দাবি করে। পরিমনির ক্ষেত্রেও তা সমান প্রযোজ্য। এছাড়া ডি এ তায়েব পোশাকে গ্রামীণ আবহের পাশাপাশি আরেকটু জীর্ণতা হলে ভাল হতো। বলা যায়, গুরু এবং প্রেমিকার বিয়োগে যে নায়ক ব্যথিত, শোকাহত এবং অনেকটাই বিদ্ধস্ত সেই দৃশে তার পরিপাটি পোশাক অনেকটাই বেমানান। বিশেষ করে একটি দৃশ্যের কথা বলা যায়, ডি এ তায়েবকে কিছু বলার জন্য আনোয়ার যখন কাছে ডাকে তখন পরিমনি ডি এ তায়েবের চুল ঠিক করে দেয়, তখন তার চুল এলোমেলো ছিল। ডি এ তায়েব যখন আনোয়ারের কাছে গিয়ে বসল তখন দেখা গেল তার চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। পাশাপাশি দুটি দৃশ্যে গেটআপের এ অসামঞ্জস্যতা সহজেই চোখে পড়েছে, যেখানে পরিচালককে সম্পাদনার সময় খেয়াল করা উচিত ছিল। তার পরেও অনেক দিন পর একটি পরিপূর্ণ গ্রামীণ ও লোকজ গল্পের চলচ্চিত্র উপভোগ করেছেন দর্শকরা এটিই বা কম কিসে। তবে ভাল চলচ্চিত্র উপভোগের জন্য ভাল প্রেক্ষাগৃহ এবং প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ সাস্থ্যসম্মত করাারও দাবি জানিয়েছেন চলচ্চিত্র দর্শকরা। তাহলে চলচ্চিত্রের সুদিন আসবেই।
×