ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতলক্ষ্যায় চলাচল করছে অর্ধশতাধিক

তিন শ’ বছরের পুরনো গয়না নৌকা, আবেদন কমেনি এখনও

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

তিন শ’ বছরের পুরনো গয়না নৌকা, আবেদন কমেনি এখনও

মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ থেকে ॥ শীতলক্ষ্যা নদীর একমাত্র গয়না ঘাটটিই উপজেলা সদরে। দীর্ঘ ৩শ’ বছরের পুরনো স্মৃতি নিয়ে এখনও মাঝিদের চাঙ্গাভাব দেখা যায়। সেই নবাবী আমল থেকে শুরু হওয়া ঢাকা জেলার তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িসংলগ্ন আদালতপাড়ার ব্যস্ততাকে ঘিরে এক সময়কার এ ব্যস্ত ঘাটটি এখনও বহাল। রূপগঞ্জ থানার পাশে ইজারাবিহীন একটি খেয়াঘাট প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন স্থানীয় মাতব্বর আজিজ মাঝি। সে সময়ে শীতলক্ষ্যা নদী পারাপারের জন্য এ উপজেলার একমাত্র গয়না ঘাটটি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। সে সময়কার শৌখিক লোকজনও বিয়ের বর-কনে সাজিয়ে এই গয়নায় চড়ত শখের বশে। সাধারণ ডিঙ্গি নৌকার অবয়ব ছাড়িয়ে বাঁশের ছাউনিঘেরা বিশেষ নৌকাকে স্থানীয়রা বলে থাকেন গয়না। এসব গয়নায় চড়ে কনের পিত্রালয় থেকে নববধূকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসা হতো। এছাড়াও খাল-বিল ও নদীতে ঘুরে বেড়ানোর প্রচলনটাও সেই ইংরেজ আমল থেকে শুরু হওয়া। শখের বশে ছাড়াও রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতেও ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওই গয়না নৌকা। এমনই চিত্র এখনও বহাল রয়েছে একই ঘাটে। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার রূপগঞ্জ সদর গ্রাম ও মুড়াপাড়ার বর্তমান ফেরিঘাটে সেই গয়নাগুলো ঐতিহ্য নিয়ে এখনও চলছে। তবে কালের পরিক্রমায় মাঝি ও পুরনো নৌকাগুলো পরিবর্তন হলেও পুরনো নক্সায় এখনও শোভা পাচ্ছে নতুন মাঝিদের বৈঠা বেয়ে চালানো গয়না নৌকা। শুরুটা নবাবী আমলে। সেই সময়ে এ উপজেলার গয়না ঘাটটিতে একেকজন যাত্রী পারাপারে এক পয়সা থেকে শুরু করে পাঁচ পয়সা গুনতে হতো। কালের বিবর্তনে একই ঘাটের একেকজনের শৌখিন ভাড়া হয়ে ওঠে পাঁচ থেকে ২০ টাকা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আসা দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহের যাত্রীসাধারণ ও রূপগঞ্জ উপজেলার শতাধিক শিল্পকারখানায় কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যান চলাচলও বেড়েছে আশানুরূপ। তাই গয়না ঘাটটিতেই বিগত দশক হতেই ফেরি স্থাপন করা হয়েছে। ফেরিটি স্থাপনের পূর্ব থেকে এ গয়না ঘাটের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। প্রথমে ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপারের সময় বিনামূল্যে যাত্রী পারাপার শুরু হলে কিছুটা মন্দাভাব বা ভাটা পড়ে এখানকার মাঝিদের। তবে কষ্টের মাঝেও টিকেছিলেন তারা। কিন্তু সেই শৌখিনতার পরিধি বেড়ে যাওয়ায় ফেরির যাত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একই ঘাটে এখনও দেখা মেলে অর্ধশতাধিক গয়না নৌকা। বর্তমানে নদীর পশ্চিম পারের থানা ভবন, উপজেলা ডাকঘর, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয় থাকায় একদিকে পূর্ব পারের সাধারণ লোকজন যেমন যাতায়াত করতে বাধ্য হন, অপরদিকে একই নদীর পূর্ব পারে উপজেলা সদর প্রশাসনিক কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা ভূমি কার্যালয়, পশু হাসপাতালসহ ও বিভিন্ন হাটবাজার থাকায় পশ্চিম পারের লোকজনও এ ঘাট দিয়ে যাতায়াত করেন। ফলে এখনও গয়না মাঝিরা দিনে ৫শ’ থেকে এক হাজার টাকা আয় করছেন। তাদের সংসার চালাচ্ছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। একই ঘাটে নিয়মিত যাত্রী তাহছিনা নিশাত বলেন, একটু বেশি টাকা নিলেও এ গয়নায় চড়তে আরাম। ছোট নদীর ঢেউয়ের তালে ও স্রোতের টানে চলা এ গয়না তাই দিন দিন আরও জনপ্রিয় হচ্ছে। এখনও উৎসব এলে নদীপথে এ গয়না ভাড়া করে অনেকেই ঘুরে বেড়ায়। তবে শীতকালে এ নদীর পানি দূষণের শিকার হলে সাধারণ পর্যটক নদীতে ঘুরতে আসেন না। স্থানীয় গয়না নৌকা মাঝিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ঐতিহাসিক এ গয়না ঘাটটি একটি মহল বন্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যাত্রীসাধারণের ভালবাসায় এখনও তা টিকে আছে। ফেরিঘাট ও শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিতব্য ইছাখালী সেতু বাস্তবায়ন শেষ হলেও এসব গয়না এ ঘাটেই টিকে থাকবে বলে তারা জানান। তাই গয়না ঘাট মাঝি সমিতি নামে একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ গয়না ঘাট সমিতির সভাপতি মাঝি মোক্তার হোসেন জানান, এ ঘাটটি অনেক পুরনো। তিনি তার বাবার কাছে শুনেছেন এ ঘাট দিয়ে ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ সেনারা নদী পার হতেন। অনেক সময় তাদের স্ত্রী-পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই সময় থেকে ’৪৭-এর দেশভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে এ ঘাটটি এখনও চাঙ্গা রয়েছে। এখানে কর্মরত প্রায় শতাধিক মাঝিই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালান। তাই এ ঘাটটি রক্ষায় প্রশাসনের সুনজর দাবি করেন তিনি। রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনায় (ভূমি) সাইদুল ইসলাম বলেন, শুনেছি এ গয়না ঘাটটি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।
×