আমি হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি। গন্তব্যটা আমার বেশ পরিচিত, কিন্তু পথ আমার সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে ক্রমাগত, পথই আমাকে দেখায় না পথ। আগে এক সময় সবুজ ঘাসের সঙ্গে কথা বলতাম, তারপর ঘাসগুলো যখন ধূসরতার দখলে চলে যায় এখন কথা বলি মাটির সঙ্গে। চৈত্রের মধ্য কোন দুপুরে পূর্ণিমার চাঁদ আর হাসনাহেনার গন্ধ খুঁজে খুঁজে আমি কতবার যে ক্লান্ত হয়েছি! অস্থির পৃথিবীর গন্ধ আমার কাছে লেগেছে মাকাল ফলের মতো বেরসিক। কী যেন হারিয়েছি, কী যেন পেয়েও পেলাম না- এমন হাহাকারের মধ্যে ডুবে থেকে চরম অস্থিরতা আমার নিত্যসঙ্গী হয়েছে। যখন পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আর স্বাদ নেয়ার তৃষ্ণা মিটে যায় তখন সবুজে সবুজময় একটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায় আমার এই কবিতা। কাব্যের পঙ্ক্তি সৃষ্টি করে আমি উপভোগ করি অপার সুখ। দুঃখ আর বিরামহীন বেদনার তাড়নায় একদিন আমি কাব্যের এই বিশাল ভুবনে হাঁটতে শুরু করি। তারপর বেশ সময় চলে গেছে। থামিনি। যন্ত্রণায় এক সময় আমি কবিতার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরাতে উদ্যত হয়েছি, বলেছি কসম খোদার ! আর এক লাইন কবিতাও লিখব না। কিন্তু কবিতাই আমার পেছন ছাড়ে না। কবিতা আমার সঙ্গী, বেঁচে থাকার অবলম্বন। যত দিন বাঁচি লিখেই যাব।
আমার দীর্ঘশ্বাসে শোকার্ত ভায়োলিন
সাগর সৈকতের মতো দীর্ঘ আমার বিরহ রেখা
ভুল বিশ্বাসে আমি সূর্যাস্ত দেখি ,তখন
দু’চোখের স্বপ্ন মিশে যায় এক অমাবস্যায়।
অলস মধ্যাহ্নে মুর্খ বাতাস আমাকে নিয়ে যায়
লজ্জাহীনা এক বিবর্ণের সেই ভুল ঠিকানায়
দীর্ঘশ্বাস থেকে বেজে উঠে শোকার্ত ভায়োলিন।
অতপর চলে নগরের মোড়ে মোড়ে উপহাসের
তুমুল আয়োজন,আমি ধুলোমাখা পথের বাঁকে
পুঁতে রাখি বিরহগাথা সরানোর এক তাবিজ।
নীল রঙের শাড়ি এবং
বলেছিলাম-
তোমার নীল রঙের শাড়িটা পুড়ে ফেলো
কিংবা দিয়ে দাও পাপ স্পর্শহীন কোন মানবিকে
ওই শাড়ির দিকে আমি তাকাতেই পারি না
ঝাঁপসা হয়ে আসে আমার চোখের জমিন।
ওই শাড়ি থেকে আমার জন্ম সহোদর ‘কষ্ট’গুলো
ঘন কুয়াশার জাল ভেদ করে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ হয়ে
ছিটকে পড়ে আমারই উদোম শরীরে, অতপর
আমি ছুটাছুটি করতে থাকি দিগি¦দিক।
মা আমার জানতেন না হয়তো ওই শাড়ির মধ্যে
লুকিয়ে আছে তার গর্ভজাত’র বিষণœ জীবন
মা’র যে কেন গাঢ় নীল রঙটা প্রিয় ছিল !
বেঁচে থাকলে আজ জিজ্ঞেস করতাম
মা -তুমি কি জানতে আমার জীবনের সাথে
মিলে যাবে তোমার প্রিয় রঙ ?
কতটা পথ হাঁটলে পথিক হবো
সুদীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অতপর আমি
প্রাচীরের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি,
আমার শরীরে এখন গোধূলির ছায়া
দারুণ স্বেচ্ছাচারি নিস্তেজ রোদ
আছড়ে পড়ছে আমার উদোম শরীরে।
আমি কিন্তু কোথাও থামিনি আগে
এবারই প্রথম- থমকে দাঁড়ালাম ।
হে বিচারক! কতটা পথ পাড়ি দিলে
অবশেষে আমি পথিক হবো ?
নি:সঙ্গ অচেনা পথের বাঁকে বাঁকে
জীবনের মানে খুঁজে কেটে গেছে বেলা
অথচ আজও আমি পথিক হতে পারিনি।
হে বিচারক! একটা কিছু বলুন –
আমি পথিক হতে পারিনি কেন ?
সেই নরম রোদমাখা শৈশবের
সঙ্গীরা কবেইতো ঝরে গেছে
অথচ তাদের ঝুড়িতে দিব্যি
জ্বলজ্বল করছে পথিকের খেতাব
আমি কিন্তু থামিনি,অথচ
আমার কাছ থেকে কত দূরে
কাক্সিক্ষত আমার পথিক খেতাব !
আর কতটা পথ পাড়ি দিলে
আমাকে পথিক বলনে, হে বিচারক !
নির্জনতার মাতলামি
এই মধ্যরাতে নির্জনতার কী অদ্ভুত মাতলামি !
আমার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তামশায় মেতে উঠে
বিষণœ অতীত আর বেরসিক সময় ।
পাহাড়ের মতো নির্জন এই ঘরটায়
ব্যথাতুর কয়েদী হয়ে পড়ে থাকি একা !
মাঝে মাঝে শিউরে উঠি, ফেলে আসা
সময়ের পাখায় ভর করে উড়াল দেই ।
একটা সময় আমার খসখসে গাল গড়িয়ে
বুক পকেটে এসে জমা হয় বেদনাশ্রুƒ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকি অপলক
অতপর ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে চোখ দু’টো
দৃষ্টি রাখে পাথর হয়ে যাওয়া দু:খের গায়ে
কু-ুলী পাকিয়ে ফের দীর্ঘশ্বাস বেরোয়
দীর্ঘশ্বাসের ভেতর থেকে আমি দেখি
রাতের নির্জনতা আর বাস্তবতার মাতলামী
নিরাশা ও দুঃখের প্রাচীর
রাত্রি জানে- কতটা কাতর আমি
নিরাশার বালিশ আমার বিছানায় পাতা
দুঃখের দেয়ালে থমকে যায় রাতের ঘুম
অবশেষে ঘুমোতে ভুলে যাই বেমালুম
দহন জ্বালা আমার বুকের ভেতর
বাইরে খেজুর কাঁটার তুমূল উল্লাস
অথচ আমি দিব্যি বেঁচে আছি আজও
এই বেঁচে থাকার অর্থটা শুধু জানে-
আমার নিথর রাত, বেঁচে তো আছি !
আমি কোন্ দিকে যাবো ! কার কাছে ?
ডানদিকে ? না , টেনে ধরে সভ্যতা ,
নগ্ন হিংস্রতা ধেয়ে আসে বামে
কিছু দুঃখ আর কিছু নিরাশার-
প্রাচীরে ঘেরা আমি, আমার রাতের ঘুম ।