ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর অমর সৃষ্টি পিয়েতা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর অমর সৃষ্টি পিয়েতা

আমি ইতালির রোম শহরে গিয়েছি অনেকবার। প্রতিবারই ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার বেসেলিকায় যাওয়া হয়েছে। প্রত্যেকবারই পিয়েতার মূর্তির সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছি অভিভূত হয়ে। আমার মন এবং দৃষ্টি বিশ্বাসই করতে চায়নি কোন মানুষের পক্ষে এমন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাস্কর্য তিনটি। তিনটিই সৃষ্টি করেছেন মাইকেল এ্যাঞ্জেলো। এ তিনটি হলো ‘ডেভিড’, ‘মোজেস’ এবং ‘পিয়েতা’। এরমধ্যে ডেভিডের মূর্তির খ্যাতি অবশ্যই বেশি। কিন্তু শিল্পবোদ্ধাদের কাছে পিয়েতার গুরুত্বও কম না। আসলে এই মূর্তি তিনটি দেখলে মনে হবে, বিধাতা স্বর্গলোক থেকে যেন মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে এই ধরাধামে পাঠিয়েছিলেন, অন্য ভাস্কর শিল্পীদের এই শিল্পকর্ম কেমন করে তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য। শিল্পী-জর্জিয়ো ভাসারি অন্য শিল্পীদের সম্পর্কে বৃহদাকারের একখানা বই লিখে গেছেন। ওই বইয়ে মাইকেল এ্যাঞ্জেলো সম্পর্কে এমন কথাই লিখে গেছেন। প্রথমবার আমি রোমে যাই ১৯৮৯ সালে। সঙ্গে ছিল আমার ছোট ছেলে শমি। ওইবার আমরা ইতালিতে ছিলাম, পাঁচ দিন। ওর ইচ্ছা ছিল ইতালির যে কয়টা শহর দেখা সম্ভব তা সে দেখবে। আমি এমন ছোট লেখায় সবকিছু লিখতে পারব না। তাই শুধু ‘পিয়েতা’ সম্পর্কে আজ লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবার সম্ভব হলে ডেভিড, মোজেস, সিসতিন চ্যাপেল সম্পর্কে এক এক করে লিখব। ১৯৮৯ সালে প্রথমবার ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে সেন্ট পিটার বেসেলিকার মার্বেল পাথরের অসংখ্য পিলার ঘেরা প্রাঙ্গণ, তার বিশালতা আর সৌন্দর্য আমার মনে অপার বিস্ময় ও সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তুলল। কেননা মাইকেল এ্যাঞ্জেলোসহ রেনেসাঁস যুগের অগণিত শিল্পী ও স্থাপত্যবিদের নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে তাদের অমূল্য শ্রমের অবদান রেখে গেছেন। শুধু তাই নয় এর পেছনে দু’শ’ বছর ধরে মহাপরাক্রমশালী পোপরাও সীমাহীন ব্যয় করেছেন। অতুলনীয় প্রতিভাবান সব শিল্পীর সাধনা আর সীমাহীন অর্থের যোগান কী অপরূপ সব বস্তু আর শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারে, তার চরম নিদর্শন ভ্যাটিকান সিটির এই প্রধানতম গির্জাÑসেন্ট পিটার বেসেলিকা। এই গির্জার সবকিছু নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার নেই। আজ লিখব শুধু মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মহত্ত্বম সৃষ্টি ‘পিয়েতা’ সম্পর্কে দু’একটি কথা। ১৪৯৮ সালে ফরাসি সম্রাটের ভ্যাটিকান প্রতিনিধি পিয়েতার মূর্তিটি তৈরি করাবেন বলে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। শিল্পীর বয়স তখন মাত্র তেইশ। ওই সময় পর্যন্ত তিনি কেবল তাঁর বিখ্যাত ব্যাকাস (সুরা এবং মদের দেবতা) এর মূর্তিটি গড়েছেন। রোমানরা বলেন, ব্যাকাস, আর গ্রীকরা বলেন, দায়ানাসাস। সে যা হোক, রোমের এক বিশিষ্ট ব্যাঙ্কার জ্যাকোপোগালি ফরাসি রাজ প্রতিনিধির সঙ্গে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, শিল্পী বয়সে তরুণ হলেও তাঁর সমকক্ষ ভাস্কর ইতালি বা ইয়োরোপে আর কেউ নেই। চারশ’ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ‘পিয়েতার’ মূর্তিটি গড়বার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন। চুক্তিপত্রে তিনি স্বইচ্ছায় একটি শর্ত যোগ করেন এই বলে যে, জীবিত অথবা মৃত যে কোন শিল্পীর যে কোন শিল্পকর্মের তুলনায় ‘পিয়েতার’ মূর্তিটি বেশি সুন্দর, না হলে তিনি কোন অর্থকড়ি গ্রহণ করবেন না। ‘পিয়েতার’ বিষয়বস্তু হলো : মারা যাওয়ার পর ক্রুশ থেকে নামিয়ে প্রভু যিশুর মৃতদেহ মা মরিয়ম তাঁর কোলে গিয়ে বসে আছেন। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় চার্চের কর্ণধাররা বাইবেলের কাহিনীভিত্তিক ধর্মীয় ছবি আঁকা এবং মূর্তি গড়ার ব্যাপারে চিত্রকর ও ভাস্কর শিল্পীদের উৎসাহিত করতে শুরু করেন। তখন থেকেই ‘পিয়েতার’ ছবি আঁকা এবং মূর্তি গড়া শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় একটা বিষয় ছিল। প্রভূ যীশু যখন মারা যান, তখন মা মরিয়ম মধ্য বয়স উত্তীর্ণ। এরকম বয়সী একজন নারীর পক্ষে পূর্ণ বয়স্ক একজন পুরুষের মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসা সম্ভব নয়। তাই মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর পূর্ববর্তী শিল্পীরা ‘পিয়েতার’ যেসব ছবি এঁকেছেন বা মূর্তি বানিয়েছেন তাতে দেখা যায়Ñ স্বর্গীয় দেবতারা যিশুর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন। মধ্যবয়সী মা মরিয়ম পুত্রের মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে আছেন এবং যিশুর মৃতদেহের ভার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পিতা যোশেফ মা মেরি মাগদালেস অথবা অন্যরা সাহায্য করছেন। এই সব ছবিতে আরও দেখা যায়, যিশু এবং মরিয়মের মাথার পেছনে আলোর দ্যুতি-বলয়। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো এসব প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্নতর কিছু সৃষ্টি করার কথা ভাবলেন। ভাবলেন, তাঁর ‘পিয়েতায়’ থাকবেন শুধু মা মরিয়ম এবং প্রভু যিশু। মা ও সন্তানের মাঝখানে অন্য কেউ থাকবে না; এমন কি দেবতারাও না। মরিয়ম এবং যিশু হবেন সম্পূর্ণরূপে মানব-মানবী। অন্য শিল্পীদের চেয়ে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর পিয়েতার আর একটি স্পট ব্যতিক্রমী বিষয় হলোÑ মরিয়মের চেহারায় বয়সের বা বার্ধক্যের ছাপ নেই। এক্ষেত্রে তাঁর চিরকুমারীর সজীবতার ছাপটাই সুস্পষ্ট। ঈশ্বর যাকে কুমারিত্ব বিসর্জন না দিয়ে মহামানব যিশুকে গর্ভে ধারণ করার জন্য নির্বাচিত করেছেন, তার চেহারায় বয়সের ছাপ না পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই ছিল মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর যুক্তি। তবে ‘পিয়েতা’ নামের মূর্তিটি তৈরি করতে গিয়ে এই মহান শিল্পী সমস্যায়ও পড়েছিলেন। একজন অল্প বয়সী মা একার শক্তিতে তাঁর কোলে পূর্ণ বয়স্ক যিশুকে নিয়ে বসে আছেন। কিভাবে এই দৃশ্যকে স্বাভাবিক আর শিল্পসম্মত করে উপস্থাপন করা যায় তাই নিয়ে। শিল্পী রোমের ইহুদী বসতি এলাকা থেকে রোসাপতিলা সব লোকজনকে বাছাই করে এনে প্রথমে তাদের মডেল করে ছবি আঁকলেন। পিয়েতা মূর্তিতে আমরা যিশুকে যেমন মায়ের কোলে শায়িত ভঙ্গিমায় দেখি, সত্যিকারের মৃতদেহকে ঠিক এমন করে শুইয়ে রেখে ছবি আঁকলেন। বসে থাকা মা মেরির পরিচ্ছেদ বিন্যাস এমনভাবে করা হলো যে, দৈহিক সামঞ্জস্য রক্ষা করেও তাঁর অঙ্গদেশ প্রশস্ততর মনে হয়। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো মাটি দিয়ে অনেকবার এই মূর্তিটি গড়েছেন এবং ভেঙ্গেছেন। যতক্ষণ মূর্তিটিকে নিখুঁত মনে না হয়েছে, ততক্ষণ ভাঙ্গা-গড়ার কাজ চলেছে। সঠিক আকার-আকৃতির উন্নতমানের পাথর পাওয়া যাওয়ার পরেই এর স্রষ্টা পিয়েতার মূর্তিটি তৈরি করার কাজে আমগ্ন ডুবে গেলেন। তিনি দৈনিক ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা করে কাজ করতে লাগলেন। পিয়েতার মূর্তির কাজ সম্পন্ন হওয়ার ছয়মাস আগেই ফরাসি সম্রাটের প্রতিনিধি মারা যান। তবে অসম্পূর্ণ পিয়েতার মূর্তির যেটুকু তিনি দেখে যেতে পেরেছেনÑ তাতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেনÑ তাঁর সময়কার কোন জীবিত ভাস্কর, তাঁর পূর্ববর্তী যে কোন মৃত ভাস্কর এবং ভবিষ্যতকালের কোন অনাগত ভাস্কর শিল্পী পিয়েতার চেয়ে সুন্দর কোন মূর্তি গড়তে পারেননি এবং পারবেনও না। ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার বেসেলিকার বিশাল আকারের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ডান দিকে তাকালেই দেখা যাবে বুলেটপ্রুফ কাচের দেয়াল ঘেরা ছোট্ট ঘরের ভেতরে রাখা আছে বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর পিয়েতার শ্বেতপাথরের মূর্তিটি। কাচের দেয়ালের খানিকটা দূর থেকে পিতলের শলাকার ঘের দিয়ে আবেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে বলে পিয়েতা মূর্তিটি আট-দশ ফুট দূর থেকে দেখতে হয়। মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর পূর্ববর্তী শিল্পীরা তাদের ছবিতে যিশুর মুখের আদলে যতটা সম্ভব ব্যাথা-যন্ত্রণা এবং মা মেরির চেহারায় যতটা সম্ভব দুঃখ-বেদনার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। মাইকেল এ্যাঞ্জেলো কিন্তু তেমন ছাপ রাখেননি। তাঁর যিশু আশ্চর্য রকমের সুন্দর সুপুরুষ। হাল্কা-পাতলা কিন্তু সবল প্রভু যিশু মৃত্যুর পর মায়ের কোলে দু’চোখ মুদে ঘুমিয়ে আছেন। দেখে মনে হয়Ñ গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলার পর সজীব ফুল ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়েছে। এমন সজীব মানুষটির নেতিয়ে পড়া চেহারা দেখে দর্শকদের মনে আরও বেশি আবেগের সৃষ্টি হয়। পিয়েতার মূর্তিতে দেখা যায় গোলাকৃতির বেদির ওপর সামনে (পরিচ্ছদের বিস্তারের জন্য আসন দেখা যাচ্ছে না) উপবিষ্ট মা মরিয়মের কোলে তাঁর সন্তানের দেহ এলিয়ে পড়ে আছে। মরিয়ম ডান হাত পিঠের নিচ দিয়ে যিশুকে ধরে আছেন। মরিয়মের ডান উরু এবং হাঁটু একটুখানি উঁচু, বাম উরু একটুখানি নিচু করা অবস্থায়। যিশুর, পা দুখানা হাঁটুর কাছ থেকে ভাঁজ করা অবস্থায় মরিয়মের পা সংলগ্ন হয়ে আছে। কোলের ওপর ধরে রাখা মৃত সন্তানের দিকে মা মরিয়ম তাঁর মুখখানি সামান্য অবনত করে নিমেষহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে-মুখে কান্নার কোন ছাপ নেই; দুঃখের কোন বিকার নেই। অথচ এমন শান্ত নীরবতার ভেতরেও অনন্ত অপার দুঃখের প্রকাশ। নীরবতারও ভাষা আছে। আর এই ভাষা পাথরে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা ঈশ্বর একমাত্র মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকেই দিয়েছিলেন। চিত্রকর, ভাস্কর শিল্পী, স্থাপত্যবিদ ছাড়াও মাইকেল এ্যাঞ্জেলো খুব উঁচুমানের কবিও ছিলেন। তাঁর রচিত সনেটগুচ্ছ ইতালীয় সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে আজও বিবেচিত। তবে কালি-কলমের পরিবর্তে ছেনি-হাতুড়ির সাহায্যে পিয়েতা গড়তে গিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন দুঃখের হৃদস্পর্শী এমন সনেট যা অন্য কোন কবি আজ পর্যন্ত রচনা করতে পারেননি। পিয়েতা ভাস্কর্যের মা মরিয়মের মুখের দিকে তাকালে অবাক হয়ে যেতে হয়। জগতের পবিত্রতম নারীর চেহারার কমনীয় সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে হয়। তাঁর মুখাবয়ব আর বাম হাতের মুদ্রায় এমন একটা অসহায় ভাব ফুটে উঠেছে, যেন তিনি বলতে চাচ্ছেন, আমার কিছুই করার ছিল না। ঈশ্বরের যা ইচ্ছা ছিল তাই হয়েছে। পিয়েতার মূর্তি আমি শেষবার যেদিন দেখি, সেদিন বেসেলিকার ট্রেজারি গৃহে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখতে পেলাম বাইরের পিয়েতার মূর্তির মতো আর একটি মূর্তি হুবহু একই রকমের। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ট্রেজারি গৃহের ভেতরে রাখা মূর্তিটা নকল। আসলটারই মোমের ছাপ নিয়ে এই নকল মূর্তিটা তৈরি করা হয়েছে। এমন করবার কারণ- কয়েক বছর আগে একজন বিকৃত মস্তিষ্ক মানুষ আঘাত করে আসল মূর্তিটার মা মরিয়মের নাকের ডগা ভেঙ্গে ফেলেছিল। পৃথিবীর সেরা ভাস্কর শিল্প বিশেষজ্ঞরা মিলেমিশে পরে মা মরিয়মের নাকের ডগা জোড়া লাগিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে আসল পিয়েতার মূর্তির চারদিকে বুলেট প্রুফ কাচের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে এবং আসলটির একটা নকল তৈরি করে রাখা হয়েছে দুর্ভেদ্য ট্রেজারি ঘরে। কোন দুর্ঘটনার কারণে আসল পিয়েতার মূর্তি বিনষ্ট হলেও দুনিয়ার বুক থেকে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর পিয়েতা হারিয়ে যাবে না।
×