ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানাবেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানাবেন প্রধানমন্ত্রী

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন অভিযান ও গণহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ তুলে ধরে এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাবেন। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের প্রস্তুতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এসব তথ্য জানান। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবারের জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। মাহমুদ আলী জানান, একাধিক কারণে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, এবারের অধিবেশন এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন হাজার হাজার নিরীহ রোহিঙ্গা প্রতিদিন প্রাণভয়ে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর। গত তিন সপ্তাহে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশ সীমান্তে ৪০ কিলোমিটার ব্যাপ্তির মধ্যেই মিয়ানমারের প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এ সকল আশ্রয় প্রার্থীর বেশিরভাগই মহিলা, শিশু এবং বয়স্ক। তিনি বলেন, এর আগে প্রায় চার লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যাদের বেশিরভাগই কক্সবাজারে অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করছে। ফলে লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গার মানবিক সহায়তা এবং তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বাংলাদেশ আজ এক নজিরবিহীন সঙ্কটের মুখোমুখি । আর এ সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণসমূহ তুলে ধরে তা সমাধানে বাংলাদেশের প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে পেশ করা হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের চলমান জাতিগত নির্মূল অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সকল রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা আমরা চলমান রাখব। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখবেন। প্রতিবারের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণসমূহ তুলে ধরে এর আশু সমাধানে বাংলাদেশের প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি অবিলম্বে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাবেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের জাতিগত নিধন অভিযান মানবতা এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে যেকোন গণহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাবেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানাবেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের উদ্যোগসমূহ তুলে ধরবেন। চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুর প্রেক্ষিতে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত ও চীনের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাইড লাইনে বৈঠক হবে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখনই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার কোন সুযোগ রয়েছে কি-না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না বলে জানতে পেরেছি। তবে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র দফতরের এক মন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে তার (পররাষ্ট্রমন্ত্রীর) সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা এই পদক্ষেপের স্বাগত জানাই। আমরা এটাই চেয়েছিলাম। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে চীনের মনোভাব জানতে চাইলে তিনি বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূত বুধবার আমাদের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখেছেন। তারা আমাদের পাশে থাকবেন বলে প্রত্যাশা করছি। আর আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ ক্রমশ প্রকাশ্য হবে বলেও তিনি জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের পিস বিল্ডিং সাপোর্ট ফান্ডে বাংলাদেশের পক্ষ হতে এক লাখ মার্কিন ডলার করে অনুদান প্রদানের ঘোষণা প্রদান করবেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার আদায়, দারিদ্র্য দূরীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের কর্মপন্থা ও সাফল্যের কথা তুলে ধরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমসমূহ তুলে ধরতে পারেন বলে আশা করা যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ১২ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশন নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দফতরে শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনের সাধারণ বিতর্ক পর্ব আগামী ১৯-২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এ বছর সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘ মানুষের ওপর বিশেষ মনোযোগ : এই গ্রহের সকলের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য সুন্দর জীবন’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নির্বাচিত হওয়ার পর এটি প্রথম সাধারণ অধিবেশন। গুতেরেস শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা সংস্কারÑএ তিনটি বিষয়কে তার কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এবারের সম্মেলনে শান্তিরক্ষা মিশনের সংস্কার নিয়ে বেশ কিছু বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এ সকল বৈঠকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তার অগ্রাধিকারভুক্ত বিষয়াবলী তুলে ধরার পাশাপাশি এসব বিষয়ের প্রাধান্য নিশ্চিত করার সুযোগ পাবে। এ বছর পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গৃহীত হয়। চুক্তিটিতে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন, তৈরি, ব্যবহার, দখল, অর্জন, মজুদ, হস্তান্তর এবং স্থাপনা অথবা পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন সংক্রান্ত কার্যাবলীতে সহযোগিতা করা বা সহযোগিতা চাওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। চুক্তিটি এবারের সাধারণ সম্মেলনে রাষ্ট্রসমূহের স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী চুক্তিটি সই করবেন। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু বিষয়ে ওআইসির কন্টাক্ট গ্রুপের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সাম্প্রতিক রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের সহিংসতা, নিপীড়ন এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এই সভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তুলে ধরবেন। এ সমস্যার আশু সমাধানে মুসলিম উম্মাহ্র দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করবেন। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ইথিওপিয়া আয়োজিত একটি উচ্চ পর্যায়ের উন্মুক্ত বিতর্কে অংশগ্রহণ করবেন। বৈঠকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পুনর্গঠন এবং সংস্কারের বিষয়সমূহ আলোচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্যোগে গঠিত পানি সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। এতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, মরিশাস, মেক্সিকো, জর্দান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সেনেগাল, পেরু ও তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানরা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের এক বৈঠকে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদানসহ যে কোন ধরনের যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি তুলে ধরে তা নিরোধে বাংলাদেশের গৃহীত উদ্যোগসমূহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরবেন।
×