ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

’৯৮ সালের বন্যার চেয়ে এবার ক্ষয়ক্ষতি অর্ধেকেরও কম ;###;এবারের বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ১০ থেকে ১৫ দিন, ’৯৮ সালে ছিল দীর্ঘ ২ মাস ;###;’১৭’র বন্যা হয়েছে সাত বছর অন্তর হওয়া ছোট বন্যার মতো ;###;নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কৃত্রিম

দু’শ’ বছরের ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস ॥ ভুল প্রমাণিত

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দু’শ’ বছরের ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস ॥ ভুল প্রমাণিত

এমদাদুল হক তুহিন ॥ দুই শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা ধেয়ে আসছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইসিএমডব্লিউএফ)। চলতি বছর আগস্টে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটি ওই পূর্বাভাস দেয়। এর প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও একাধিক প্রতিবেদন প্রচারিত হতে থাকে। মুখে মুখে ‘ইতিহাসের বড় বন্যায়’ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ‘বন্যাভীতি’। হঠাৎ লাফ দিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্য উঠে দ্বিগুণের কোঠায়। এতে মধ্য আগস্টে জনজীবনে দেখা দেয় চরম শঙ্কা। চলতি বছর বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সময় তাই প্রশ্ন উঠেছে, এবারের বন্যা আসলে কেমন ছিল? ক্ষতির ধরন কেমন? সত্যিই কী তা ছুঁয়েছে পূর্বের কোন রেকর্ড? এসব প্রশ্ন সামনে রেখে তথ্য পর্যালোচনা করে জনকণ্ঠের দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০ বছরের ইতিহাস তো নয়ই, চলতি বছরের বন্যা ’৯৮ সালের বন্যার রেকর্ডও ছুঁতে পারেনি। বরং ক্ষতির অধিকাংশ দিক থেকেই এটি ’৯৮ সালের অর্ধেকেরও কম। স্থায়িত্বের দিক থেকে, চলতি বছরের বন্যা ১০ থেকে ১৫ দিন স্থায়ী হলেও ’৮৮র বন্যার স্থায়িত্বকাল ছিল ১৫ থেকে ২০ দিন। আর ’৯৮ সালে তা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ দুই মাস। প্রাণহানির দিক থেকে এটি ছিল ’৮৮ সালের তুলনায় দশ ভাগের এক ভাগ। আর ’৯৮ সালের তুলনায় এটি ৬ ভাগের একাংশের সমতুল্য। একই সঙ্গে পূর্বের তুলনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণও কমেছে। ’৯৮ সালে ৪ হাজার ৫২৮ কিমি বাঁধ সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবারের বন্যায় তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯৬ কিমি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্যমতে, ’৯৮ সালের বন্যায় ৩২ লাখ ৩৪ হাজার ৫২৬ একর ফসলিজমি সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চলতি বছরের ফসলি জমির ক্ষতির পরিমাণ ৬ লাখ ৩ হাজার ৯ একর। অর্থাৎ ’৯৮ সালের বন্যায় চলতি বছরের তুলনায় প্রায় ৫ গুণের অধিক ফসলিজমি তলিয়েছিল। আর ’৮৮ সালের বন্যায় চলতি বছরের তুলনায় ১১ গুণের বেশি ফসলিজমি তলিয়ে যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, বছরটিতে দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৮৬ হেক্টর ফসলিজমি সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতির কবলে পড়ে। এক্ষেত্রে, সারা দেশে দ-ায়মান ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১০ শতাংশ। আর আক্রান্ত জেলাগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৭ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে দুটি বড় বন্যার সঙ্গে ২০১৭ সালের বন্যার পার্থক্য ব্যাখ্যা করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ’৮৮ বা ’৯৮-এর বন্যায় চেয়ে এবারের বন্যায় আক্রান্ত এলাকা ও মৃত মানুষের সংখ্যা উভয়ই ছিল কম। এছাড়া ’৮৮ ও ’৯৮’র বন্যার স্থায়িত্বকাল ছিল অনেক বেশি, এবারের বন্যা তারও কম ছিল । তবে ’৮৮ ও ’৯৮ এর বন্যায় ধীরে ধীরে পানি বাড়লেও এবারের বন্যায় হঠাৎ পানি বেড়ে যায়। আশঙ্কা থাকলেও দ্রুত বন্যা মোকাবেলা করতে পারায় আগের তুলনায় ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের পূর্বাভাস ব্যবস্থার সক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমনি দুর্যোগ মোকাবেলায়ও। এছাড়াও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দুর্যোগ মোকাবেলা সহজ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, ৩২ জেলায় এবার গড়ে ১০ থেকে ১৫ দিন বন্যা স্থায়ী হয়েছে। দিনাজপুরে বন্যা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৪ দিন। অন্যান্য জেলার মধ্যে কুড়িগ্রামে ৭ দিন, জামালপুরে ১৩ দিন ও সিরাজগঞ্জে ২১ দিন। এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পরিস্থিতি ও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্বে দেশে যেসব বড় বন্যা হয়েছে সেসব বন্যা ছিল দীর্ঘস্থায়ী। ’৯৮ সালে বন্যা ৭৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ২০০৪ সালের ঢাকা কেন্দ্রিক বন্যাও ছিল দীর্ঘ সময়ের। এবারের বন্যা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর কয়েক বছর ধরেই তা হচ্ছে না। আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মধ্য আগস্টে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পানি যেভাবে বাড়ছিল তা দেখে বিশ্বের কয়েকটি সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছিল। বাইরে থেকে তারা কথা বলতে পারে, তারা আমাদের সচেতন করে দিতে পারে; তবে তাদের দায়িত্ব কিন্তু প্যানিক সৃষ্টি করা নয়। বন্যার সঙ্গে এদেশের মানুষের সম্পর্ক আদিকালের। তাই বন্যার ভয় দেখিয়ে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ানো ঠিক নয়। যারা এসব প্রোপাগান্ডা সৃষ্টি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাস দেয়ার জন্য তারা কিন্তু কোন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। কারণ বর্তমানে আমরা আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে বেশ ভাল পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হচ্ছি। তবে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের মতে এবারের বন্যা আগের বড় বন্যাগুলোর তুলনায় কোন অংশে কম নয়। জনকণ্ঠের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা নদীর পানি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে যে পূর্বাভাস দিয়েছিল এ বছরের বন্যায় তা মোটামুটি ঠিক হয়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ অর্থাৎ বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে নদীর পানি বাড়লেও তুলনামূলক তা লোকালয়ে প্রবেশ করেনি। একই সঙ্গে দেশের বহু জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবকাঠামো টিকে গেছে। ফলে লোকালয়ে পানি প্রবেশ না করায় বন্যা পূর্বের বছরের মতো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এতে ক্ষতি কম হয়েছে। এছাড়া জনগণ ও সরকারের সচেতনতায় যে কোন দুর্যোগেই পূর্বের তুলনায় এখন ক্ষতি কম হয়। তিনি বলেন, এ বছরও ভয়াবহ বন্যা হয়েছে ঠিকই কিন্তু দেশের অবস্থা এখন আর ১৯৮০ সালের মতো নেই। ’৮৮ সালে শ্যামলীতে পানি উঠলেও বর্তমানে ঢাকা সুরক্ষিত থাকায় এবার সেখানে পানি ওঠেনি। আর দেশে বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটায় আগাম ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে। এতেও ক্ষতি কমছে। ক্ষতিতে চলতি বছরের বন্যা ’৯৮ সালের তুলনায় অর্ধেকের চেয়েও কম ॥ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৮৮ সালের প্রথম ধাপের বন্যায় ২৩ জেলার ১৬৫ উপজেলা আক্রান্ত হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫২ জেলার ৩৪৬ উপজেলা আক্রান্ত হয়। আর ’৯৮ সালে ৫৩ জেলার ৩৭০ উপজেলা আক্রান্ত হয়। তবে চলতি বছর মৌসুমের দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৩২ জেলার ২০৮ উপজেলা আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বড় দুটি বন্যার তুলনায় চলতি বছরের বন্যা জেলা ও উপজেলা ভিত্তিতে আক্রান্তের দিক থেকে কয়েকগুণ কম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালের প্রথম ধাপের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩১ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার ৭২৪। এতে ৮ লাখ ৪৬ হাজার ২০৯ একর ফসলিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ফসলিজমির পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪০ একর। সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৯১ হাজার ১৬২। বছরটিতে প্রথম ধাপের বন্যায় মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৪। মৃত গবাদিপশু ও হাঁস- মুরগির সংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৭৬। সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৩৮৭। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার পরিমাণ ৬ হাজার ৮৬১ কিমি। ৩১২ ব্রিজ বা কালর্ভাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভেঙ্গে পড়েছিল ৬৭ কিমি বাঁধ। তবে বছরটির প্রথম ধাপের বন্যায় ক্ষতি কিছুটা কম হলেও দ্বিতীয় ধাপে বন্যা আরও প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠে। ভয়াবহ ওই বন্যার দ্বিতীয় ধাপে ৫২ জেলার ৩৪৬ উপজেলা আক্রন্ত হয়। ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৬। আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ফসলিজমির পরিমাণ ৫৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৯৫ একর। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩৫। মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৫১৭ । মৃত গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪২। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯ হাজার ৯৯। সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৫৯ হাজার ৯৫৬ কিমি। ক্ষতি হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৭ ব্রিজ বা কালভার্টের। আর বছরটির দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ১ হাজার ৬৫১ কিমি বাঁধের ক্ষতি হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় বন্যাটি হচ্ছে ১৯৯৮ সালে। ওই বছর ৫৩ জেলার ৩৭০ উপজেলা আক্রান্ত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৩৮ হাজার ৪২২ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫৩। আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ফসলিজমির পরিমাণ ৩২ লাখ ৩৪ হাজার ৫২৬ একর। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৯৭। মৃত মানুষের সংখ্যা ৯১৮। মৃত গবাদি ও হাঁস-মুরগির সংখ্যা ২৬ হাজার ৫৯১। সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৯০। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৬১ হাজার ৮২৩ কিমি। ১ হাজার ৮৯০ ব্রিজ বা কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫২৮ কিমি। আর চলতি বছরের দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ৩২ জেলার ২০৮ উপজেলা আক্রান্ত হয়। এতে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৩২৪ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৮২ লাখ ২ হাজার ২৫। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলিজমির পরিমাণ ৬ লাখ ৩ হাজার ৯ একর। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৭। মৃত মানুষের সংখ্যা ১৫০। আর ৮৪ হাজার ৭৭০ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ৪ হাজার ৭৬৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৫। ১০ হাজার ৪৬৯ কিমি রাস্তার আংশিক ক্ষতি হলেও চলতি বছরের বন্যায় ৮৯০ কিমি রাস্তা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৪৯ ব্রিজ বা কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতি হয়েছে ৭৯৬ কিমি বাঁধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য-উপাত্তই প্রমাণ করে এবারের বন্যা ৩০ থেকে ৫০ বছরের ইতিহাসেরও কোন বড় বন্যা তো নয়। বরং এটি ৭ বছর অন্তর হয়ে থাকা ছোট বন্যার মতো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৬ লাখ ৭২ হাজার ৫৮৬ হেক্টর ফসলিজমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। তবে বন্যায় আক্রান্ত ওসব জেলায় দ-ায়মান ফসলিজমির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৩ হেক্টর। এক্ষেত্রে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে প্রায় ১৭ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হয়। আর একই সময়ে দেশে মোট দ-ায়মান ফসলিজমির পরিমাণ ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৫ হেক্টর। এক্ষেত্রে সারা দেশে ফসলিজমির আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। তবে পানি সরে যাওয়ার পর কোন কোন আমনের ক্ষেত নতুন করে জেগে উঠেছে। আবার কোন কোন জমিতে নতুন করে চারা লাগাচ্ছে কৃষক। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ গোলাম মারুফ চলতি বছরের বন্যায় কৃষির ক্ষতি প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। বন্যার ইতিহাস ॥ বন্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে পুনঃপুনিক ঘটনা হওয়ায় এটি ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৮৮ সালের বন্যাকেই সবচেয়ে বড় আকারের বন্যা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। সে বছরের বন্যায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। স্থানভেদে বন্যাটি ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ’৮৮ সালের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উভয় বছরই দেশটি ছিল বন্যাকবলিত। ’৮৭ সালের বন্যায় দেশের ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বছরটিতে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা পানি নিমজ্জিত ছিল। আর ’৮৭ সালের বন্যার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বলা হয়ে থাকে, এ ধরনের বন্যা ৩০ থেকে ৭০ বছরে একবার ঘটে থাকে। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বন্যা অর্থাৎ ’৮৮-র বন্যার পরের বছরও কয়েকটি এলাকা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ’৮৯ সালের বন্যায় সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও মৌলবীবাজারের ৫ লক্ষাধিক লোক পানিবন্দী হয়। তবে ’৮৮’র বন্যার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, এ ধরনের বন্যা ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে একবার ঘটে। আর এ বিষয়ে তথ্য পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ব্যাপক বন্যা প্রতি ৭ বছরে একবার এবং মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা প্রতি ৩০ থেকে ৫০ বছরে এই জনপদে হানা দিতে পারে। অপরদিকে, ১৯৯৮ সালের বন্যাটিও বংলাদেশে ভয়ঙ্কর বন্যাগুলোর মধ্যে অনত্যম। বলা হয়ে থাকে, ভয়াবহতার দিক থেকে ’৮৮’র বন্যার পরেই এর অবস্থান। বছরটিতে বন্যা স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ দুই মাস। ওই বন্যায় ডুবে গিয়েছিল দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। তবে চলতি বছরের বন্যায় দেশের এক- তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়। ভয়াবহতার দিক থেকে তা ’৯৮’র সালের ক্ষতিকেও স্পর্শ করে না। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা ও সামগ্রিক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন কিছুর ওপর নির্ভর করে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা এখনও বলা যায় না। তার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্যার প্রকৃত ক্ষতি সম্পর্কে এখনও সঠিক মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে আমন লাগানোর সময় প্রায় শেষ। দু’একটি অঞ্চলে হয়ত লাগানো যাবে। তিনি আরও বলেন, চালের বাজারে দাম কিন্তু এখনও কমেনি। বরং বেড়েই চলছে। আর ৬ মাসে সরকার কতটুকু চাল আনতে পেরেছে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। দেশে বেসরকারী খাতে যে চাল এসেছে তা সরকারের কিনে নেয়া উচিত ছিল। কথাটি অনেকদিন ধরে বলে আসছি। কিন্তু সরকার তা করেনি। কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে সরকারীভাবে বিতরণকৃত আমনের চারা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে এই কৃষি বিশেষজ্ঞ বলেন, মাত্র ৯ হাজার কৃষকের মধ্যে চারা বিতরণÑ এটা খুবই অপর্যাপ্ত। এতে উপজেলা পর্যায়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫ জনের মধ্যে আমনের চারা বিতরণ হয়েছে। ইতিবাচক হলেও এটি তেমন কোন ফল বয়ে আনবে না। ভবিষ্যতে আরও বেশি চারা বিতরণের লক্ষ্য থাকতে হবে।
×