ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদ মুস্তাফিজ

অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দলিল

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দলিল

বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহল এক সময়ের বাংলাদেশের আরোপিত সমস্যা। আমরা জানি সাম্রাজ্যবাদী নিগড় থেকে ভারতবর্ষের কাছে ঐতিহাসিক মুক্তিলাভের বিশেষ বাস্তবতা। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক সুবিধা বঞ্চিত মানুষের আশা-ভরসা, নিরাপত্তাহীনতা, চরম দারিদ্র্যের জীবন যুগের পর যুগ পার করেছে এই ছিটমহলবাসিন্দা। এর দায়ভার এবং মুক্তিদানের দায়িত্ব কার ছিল আমরা এড়াতে পারি না। আজ ৬৮ বছর পর ঝুলে থাকা বাংলাদেশ-ভারতের ছিটমহল অবশেষে একটা সঠিক রূপ পেল। ছিটমহলবাসী আজ বিমুক্ত-স্বাধীন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার রাজা সহিদুল আসলামের সম্পাদনায়Ñ‘বাংলাদেশে-ভারতের ছিটমহল’ গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করল। এই সম্পাদনায় রাজা সহিদুল আসলাম সূচিবদ্ধ করেছেন আলফাজ আইয়ুবের গদ্য-‘ছিটমহল : ঔপনিবেশিক দায়ভার এবং উত্তর ঔপনিবেশিক দায়মুক্তির উপাখ্যান’, এই গদ্যের ভেতর ছিটমহলবাসীর জীবন, সমস্যা, তদানীন্তন পরিস্থিতি দীর্ঘসূত্রতার রক্তক্ষয়ী মানুষের আশাহীনতা, আস্থাহীনতার প্রকৃত কারণ উঠে এসেছে। এ ছাড়া এই গদ্যে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হত্যা ষড়যন্ত্র, বিট্রিশ বেনিয়াদের ক্রীড়নক, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছর পর সম্পাদিত চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই ছিটমহলসমূহ হস্তান্তর এবং অপরের সার্বভৌমত্বে বিস্তারিতসহ ইন্দিরা-মুজিব ‘স্থল সীমানা চুক্তি’ নিয়ে সুদীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন লেখক। সসীম কুমার বাড়ৈয়ের রচনা ‘ছিটমহল : এক যে ছিল কাঁটাতারে জীবন’ যার ভেতর ছিটমহলবাসিন্দার মর্মান্তিক জীবনকথা বেরিয়ে এসেছে। মোঃ হাবিবুর রহমানের গদ্যÑ ‘বাংলাদেশ ভারত ছিটমহল বিনিময় : প্রসঙ্গ কথা’ শীর্ষক রচনায় ছিটমহলের উৎপত্তির পটভূমি এবং সমাধানের প্রচেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেছেন। তাহমিন হক ববির রচনাÑ ‘র‌্যাডক্লিফ থেকে ৬৮ বছর অতঃপর...’ নামক গদ্যে ৬৮ বছরের বন্দীজীবন, হাসিনা-মনমোহনের প্রটোকল, বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলের জরিপ, সীমান্ত চুক্তির নেপথ্যে হাসিনা-মোদি, ছিটমহল আন্দোলনের সূত্রপাতসহ এবং ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতা ও নাগরিকতার প্রসঙ্গটি খুব জোরালোভাবে উঠে এসেছে। গাল্পিকচরিত্রে ছিটমহলের বর্ণনাধর্মী রচনা তিনটি গল্প ‘ছিটগ্রন্থ’ লিখেছেনÑ আউয়াল আহমেদ, এটি একটি গল্পপরম্পরায় জীবন আখ্যান-গাল্পিকঢঙের আঞ্চলিকতার প্রাণময় বিন্যাসে প্রকাশিত। আবার গল্পচারিতায় একটি রচনা ‘ঝিগাবাড়ি ছিটের শেষসূর্য’ লিখেছেন- সেলিম মোঃ শহিদুল আলম। গল্পের বিভিন্ন চরিত্রে লেখক তুলে এনেছেন নির্বিকার ছিটমহলের আদ্যপ্রান্ত। নিটোল গল্পের বাইরে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ গদ্য সূচিবদ্ধ হয়েছে- রাফিক আহান্জের ‘মধ্যরাতে স্বাধীনতা ও শিকল ভাঙার উল্লাস’, এই রচনায় লেখক অন্ধকার জীবনের অবসান, বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস-মুক্তির আনন্দ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহল যা এখন বাংলাদেশের আবার ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল যা এখন ভারতের পর্বটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। প্রথম পর্বের একেবারে শেষে সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলামের লেখাটি দৃষ্টি কেড়েছে এ জন্য যে লেখক তার রচনায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ভিন্ন আঙ্গিকের গদ্য লিখেছেনÑ ‘একই মানুষ অথচ আলাদা, সাব অলটার্ন নাকি অন্য কিছু।’ লেখকের এই রচনার মধ্যে সত্যরূপ গুণের বাস্তবের মুখোমুখি করেছেন পাঠককে। এই বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে সময় লাগল ৬৮ বছর। অথচ মানুষই রোপণ করেছে খেলাচ্ছলে এই বিষবৃক্ষ।’ আমরা আরও লক্ষ্য করি গদ্যের সাব অলটার্নের অবসান ঘটান লেখক এভাবে ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৬৮ বছর পর মানুষের জয় হলো, মানবতার জয় হলো। ছিটমহলের বাসিন্দারা ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে ডানা মেলে উড়বার অধিকার পেল।’ এই গ্রন্থে তিনটি পরিপূর্ণ গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুহাম্মদ শহীদ উজ জামান লিখেছেন গল্প- ‘দ’, একজন হাজেরা আর ছেলে পোহাতুর কথোপকথনের ভেতর ছিটমহলবাসীর হাহাকার জীবনের নিদারুণ চিত্র এঁকেছেন। আজমত রানা লিখেছেন- ‘ন’, চমৎকার উপস্থাপনায় গল্প লিখেছেন। গ্রন্থের শেষ গল্পটি লিখেছেন আফরোজা পারভীন রিকা ‘নেকড়ে নিধন পর্ব-১’, করতোয়ার জীবনঘেঁষা আখ্যান-মালতির ভরা যৌবন অবসানের মর্মান্তিক কাহিনী। বাংলাদেশে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটাতে অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি যেমন আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হয় তেমনি নিজস্ব ভূ-খন্ড প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চূড়ান্ত করা অতি জরুরী। আমার ধারণা এই আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে সবার সার্বিক সহযোগিতা যেমন দরকার, বিরোধ-মীমাংসা নিষ্পত্তির জন্য আমাদের নতুন আন্তঃরাষ্ট্রিক আইন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠাও তেমন প্রয়োজন। নিশ্চয়ই জনগণের প্রগতিশীল ধারায় তাদের ন্যায্য আধিকার রক্ষা ও আইনে আন্তর্জাজিক (ফেডারেল) নজরদারি- বিশ্ব রাষ্ট্রের ভূমিকা একটি দেশের কাম্য হতে পারে। আজ ৬৮ বছরে দাবিকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে স্বস্তির হাওয়া বইছে- ছিটমহলবাসী প্রাণভরে নিশ^াস নিচ্ছে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। রাজা সহিদুল আসলাম একজন সম্পাদকই নন বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত গল্পকারও বটে। তার হাতে এই গুরুত্বর্পূণ সম্পাদনা গ্রন্থটি বাংলাদেশ-ভারতের ভৌগোলিক সীমারেখা নিরূপণ তথা রাষ্ট্রিক সীমানা অধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। গ্রন্থটি পড়ার পর মনে হয়েছে এটি ভিন্ন একটি জগত ছিল। দূর থেকে যা বোঝা কঠিন।
×