ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

শরৎ সাহিত্যে নারী

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শরৎ সাহিত্যে নারী

শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য জনপ্রিয়তম নাম। তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের উপন্যাস এবং ছোটগল্প পাঠকদের অত্যন্ত প্রিয়; বলা যায় শরৎ চন্দ্রের জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্যের একটি বড় অংশ অপূর্ণই থেকে যেত। গত এক শ’ বছর ধরে তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের কাহিনীগুলো প্রবাদতুল্য হয়ে পাঠকের মন জয় করে চলছে। তিনি তার রচনার শিল্পরীতিতে, কাহিনী সৃষ্টিতে ও পল্লী জীবনের এবং সর্বোপরি এ অঞ্চলের মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল দিকটি ও সামাজিক জীবনের দ্বন্দ্ব-দ্বিধা, ভয়, আনন্দ, ভালবাসা, প্রেম, প্রীতি, দ্বেষ-বিদ্বেষ আবার ক্ষুদ্র মানব মনের অপার মহিমাকে অনন্যভাবে নিবৃত্ত করে গেছেন। সাহিত্যে সাধারণ মানুষের জীবনকে এত প্রাঞ্জল ও নিষ্ঠার সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন যে এক্ষেত্রে অন্য কাউকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা যায় না। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের অবহেলিত, গরিব আর নিপীড়িত নারীদের বঞ্চনা তার উপন্যাসের মূল একটি বিষয়। পল্লী জীবনাচার, মানুষের অসহায়ত্ব, বিশেষ করে নিঃস্ব মানুষের ওপর জমিদার ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের অনিঃশেষ অত্যাচার, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী, বিবাদপ্রিয়, লোভী, স্বার্থপর, অনিষ্টকারী, ঘৃণী মানুষ যাদের নিশানা সম্বলহীন, নিপীড়িত, দুর্বল এই সমস্ত মানুষের দুঃসহ জীবন আবার এর উল্টো পিঠে মমতাময়ী, করুণাময়ী, উদার, পরোপকারী, স্বার্থত্যাগীদের এমনভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন তা কাল্পনিক হয়েও পাঠকের বাস্তব যেমনটা দেবদাস, পার্বতী ও চন্দ্রমুখী বাস্তব চরিত্রের মতো হয়ে আছে। শরৎ চন্দ্রের রচনায় তাই আমরা সুচারু, প্রখর, সূক্ষ্ম ও নিবিড়ভাবে মানব চরিত্র ও জীবনপ্রণালী অবিশ্বাস্য জীবন্তভাবে আবিষ্কার করি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেখানে অবরুদ্ধ, পুরুষের শক্তির কাছে বন্দিনী, ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোঁড়ামির বলি, দুর্বল বলে শঠ, প্রতারক পুরুষের শোষণের বস্তু ঠিক সেখানেই নারী চরিত্রগুলো ভালবাসা, প্রেম, প্রীতি, মমতা, ¯েœহ, করুণা, দয়া, ত্যাগ, কখনওবা প্রতিবাদী হয়ে মানবিকতার সুবৃহৎ ঐশ্বর্যকে আরও দীপ্তিময় করে তোলে। শরৎ চন্দ্র তার চরিত্রগুলো সুনিপুণ দক্ষতায় সৃষ্টি করে একটি অখ-কালের সাক্ষী করে সামাজিক সব বিষয়কে অমর করে গেছেন। শরৎ সাহিত্যে প্রতাপশালী, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী পুরুষরা অনেক সময়েই কোমলপ্রাণ, সরল কিন্তু হৃদয়বতী নারীদের কাছে এসে পরাজয় স্বীকার করে। শরৎ সাহিত্যে নারী একটি প্রধান অংশ জুড়ে; নারীকে প্রাধান্য দিয়ে লেখক ঘুণে ধরা, পচনশীল, অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে যে সত্য, সুন্দর আর উৎসর্গ দিয়ে আলোকিত করে রাখে সেই নারীকেই সর্বাগ্রে রাখেন। শরৎ চন্দ্রে প্রায় তিরিশটি উপন্যাস ও গল্পসঙ্কলনে নারী চরিত্রগুলো বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে; এখানে এমনি কিছু বিশেষ নারী চরিত্রকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তার উপন্যাস পল্লী সমাজ, অরক্ষণীয়া, দেনা-পাওনা, বড়দিদি ও এবং ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, বিলাসী, মহেশ ইত্যাদি ছোটগল্পে নারী চরিত্র ও পল্লী বাংলার নানামুখী সংঘাত-দ্বন্দ্ব, মানবিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব, নারীর অসহায়ত্ব এবং দুঃখীর বেদনাময় করুণ জীবনচিত্র অমলিনভাবে অঙ্কিত। তার উপন্যাস পল্লী সমাজে শহর থেকে শিক্ষিত হয়ে আসা রমেশের গ্রাম উন্নয়ন আর সমাজসেবার যুদ্ধ চলে গ্রামের কুচক্রী মহল আর তার আত্মীয়স্বজনের প্রতিকূলে অন্যদিকে অসহায় বিধবা রমা যে রমেশের সততার জন্য তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রমেশকে তার বড়দা লোভী, অত্যাচারী বেণীর চক্রান্ত থেকে রক্ষা করতে চায় কিন্তু তার বড়দারই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সমাজ এই দুই মহাপ্রাণ নরনারীর জীবনকে বিফল, পঙ্গু, ও ব্যর্থ করে দেয়। উপরন্তু, বেণী ও গোবিন্দ হালদার আর তার সহচরেরা পরোপকারী রমেশের গ্রামের নিদারুণ অসহায় মানুষের হিতকাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রমা নারী তাই মুখ বুজে শুধু সব সহ্য করে যায় আর গ্রাম্য মোড়লদের সৃষ্ট নীতিহীনতার বেড়াজাল থেকে না পারে নিজে মুক্ত হতে না পারে সাহসী রমেশের পাশে এসে তাকে সাহায্য করতে বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যে পুরুষের তৈরি নিয়মে নিজেকে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিজেই কখন আত্মবিলীন হয়ে যায় তার স্বাক্ষর মিলে। অন্যদিকে শিক্ষিত, সাহসী রমেশ উপলদ্ধি করে যে, কুসংস্কারাচ্ছ কুঁয়াপুর গ্রামের মানুষদের ভালো করতে যাওয়া ভীষণ বিড়ম্বনার বিষয়। কিন্তু রমা যে সামাজিক হিংসা আর বিধীনিষেধের কারণে রমেশের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রকাশে ব্যর্থ রমেশ তাও জানতে পারেনা ; রমার সে রাস্তাও যে বন্ধ। কিন্তু রমার সবচেয়ে বড় কষ্ট সে সচেতন কিন্তু তার বড়দা বেণী, চতুর গোবিন্দ গাঙ্গুলী প্রমুখের গ্রামে অন্যায় অত্যাচারের অনিচ্ছুক সমর্থনকারী হতে বাধ্য হয় ও রমেশের হিতাকাঙ্খী , পরোপকারী সত্তাকে সে ইচ্ছা থাকলেও সমর্থন দিতে পারেনা বরং পুরুষ শাসীত সমাজের চাপে পড়ে রমেশের বিরুদ্ধে কোর্টে মিথ্যা সাক্ষী হয় কিন্তু রমেশের জন্য তার গভীর ভালোবাসা শুধু অপ্রকাশিত নয় তাকে অসহ্য বেদনায় জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে ; তার অস্তি¡তকে একেবারে নিঃশেষ করে দেয়। রমেশ যখন গ্রাম উন্নয়নের জন্য দুঃখী, পরিত্যাজ্য মুসলমানের পাশে এসে দাঁড়ায় সমাজের অধিপতিরা তার ঘোর বিরোধী ও চরম শত্রু হয়ে যায় আড়াল থেকে রমাই মনেপ্রাণে ব্যাকুলভাবে শুধু প্রার্থনা করতে পারে রমেশের জন্যে আর একজন নারী চরিত্র বিশ্বেশ্বরী রমেশের জ্যাঠাইমা তাকে সহ¯্র প্রতিকুলতায় সাহস দেয়। তার জ্যাঠাইমা বর্ষিয়সী তাই রমেশকে কিঞ্চিত হলেও সামনাসামনি সাহায্য করে কিন্তু বিধবা রমা যেদিন ভোরবেলা রমেশের বাড়ি থেকে বের হয়ে বেণী ঘোষালের অপবাদের মুখে পড়ে এবং প্রতিবাদী হয় রমার রমেশের প্রতি সমর্থনের চিহ্ন মেলে কিন্তু রমার এই প্রতিবাদ সাগরের বুকে খড়কুটোর মতো কারণ সে সমাজে অবাঞ্চিত বিধবা। তাই শরৎচন্দ্রের অভিমত- ‘পুরুষের তত মুস্কিল নেই, তার ফাঁকি দেবার রাস্তা খোলা আছে, কিন্তু কোথাও কোনো সূত্রেই যার নিষ্কৃতির পথ নেই সে শুধু নারী।’ রমা রমেশের ভালটা বুঝে তাই বিশ্বেশ্বরীকে বলে ‘কিন্তু রমেশদা সত্যিই তো আর চুরি-ডাকাতি করে বেড়ায় না, বরং পরের ভালর জন্যই নিজের সর্বস্ব দিচ্চেন, সে কথা তো কারও কাছে চাপা থাকবে না।’ হ্যা তা একদিন চাপা থাকে না রমেশ একদিন জেল থেকে বেড় হয়ে আসে আর এসে বীরের মর্যাদাই পায় কিন্তু বিধবা রমা যে সমাজের বলি হয়ে রমেশকে নিজের হৃদয়কে খানখান করে রমেশকে জেলে পাঠায় বেণীর ষড়যন্ত্রে সে স্বেচ্ছা নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়। উপন্যাসটা যখন শেষ হয় পাঠক হৃদেয়ে বেদনার প্লাবন বয়ে যায় শুধু বিশ্বেশ্বরীর রমাকে বলা কথাগুলো কিছুটা ব্যথা প্রশমিত করে- ‘কিন্তু তোমার তো হাত ছিল না মা। মেয়ে মানুষের কলঙ্কেও ভয় দেখিয়ে যে কাপুরুষরা তোমার ওপর এই অত্যাচার করেছে, সমস্ত গুরুদ-ই তাদের।’ অরক্ষণীয়া উপন্যাসও আমাদের মনে এক সমাজ পরিত্যক্তা নারীর (কিশোরীর) চরম দুর্দশায় গভীর বেদনা সঞ্চার করে। অরক্ষণীয়া নামটিই প্রকাশ করে সমাজে নারী কতটা অরক্ষিত। এই উপন্যাসের জ্ঞানদা চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম করুণ নারী চরিত্র। জ্ঞানদা একটি ছোট এগারো বছরের নাবালিকা মেয়ে (কিন্তু তার মামার কথায়-একটা সোমত্ত মাগী) সমাজ দ্বারা যেভাবে নির্যাতিত হয় তা ব্যাখ্যাতিত কিন্তু তার মতো মেয়ে শুধু যে সাহিত্যেই মিলে তা নয় এখনও দরিদ্র গ্রামে এ রকম অনেক মেয়ে সমাজের কুৎসিত খেলার শিকার। জ্ঞানদা ছিল শ্যামলা কিন্তু গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে বাঙালী সমাজে কালো বলেই তিরস্কৃত হয়। তাছাড়া সে ছিল পিতৃহীন তাই আরও অবহেলিত; বড় বউ যে সন্তানহীন জ্ঞানদার জ্যোঠাইমা, মামা, পাড়া প্রতিবেশী সবাই জ্ঞানদার ঘোরতর শত্রু। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, উপেক্ষা, উপহাসে জ্ঞানদা চরিত্রটি সিনডেরেলার কথা মনে করিয়ে দেয় কিন্তু এতটুকুন বয়সে তার ওপর যে মানসিক নিপীড়ন চলে তা সিনডেরেলার চেয়ে ভয়ঙ্কর। তার মা দুর্গামনি বিধবা হওয়ার পর জ্ঞানদা আর তার মাকে তার চাচা-চাচিরা তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়; স্থান হয় তার মামার বাড়ি এক পচা, অন্ধকারাচ্ছন্ন, দরিদ্র গ্রামে। বস্তুতই তার মামা আর মামি দীর্ঘকাল পড়ে তাদের সমাদরে গ্রহণ করে না। সেখানে জ্ঞানদার শঠ মামা, শম্ভু চাটুর্য্য জ্ঞানদাকে তার বুড়ো কয়েক সন্তানের জনক বিপতœীক শ্যালকের সঙ্গে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগে টাকার লোভে। অতুল বড়লোকের ছেলে যে তরুণ বয়সে জ্ঞানদার বাবার মৃত্যুকালে কথা দিয়েছিল জ্ঞানদাকে বিয়ে করবে এবং সত্যি সত্যি সে এক সময় জ্ঞানদাকে ভালবাসত কিন্তু সে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ভুলে যায়। জ্ঞানদার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। এদিকে জ্ঞানদার মা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হরিপালে শয্যাগত হয় মেয়ের চরম দুর্ভাগ্য তাকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে; জ্ঞানদাও ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়। টাকার লোভী মামা যখন তার খুনী শ্যালকের সঙ্গে জ্ঞানদার বিয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তখন অকস্মাত তার মামি ভমিনী তাকে উদ্ধার করে হরিপাল থেকে; তার মামার খপ্পর থেকে পালাতে সহায়তা করে। এই ভগ্ন দশা নিয়ে আর একটু আশা নিয়ে তারা ফিরে আসে নিজ ভূমে; কিন্তু যে আশা নিয়ে জ্ঞানদার মা আশা গুনছিল চির অভাগা জ্ঞানদার বিয়ে হবে শিক্ষিত, বংশীয় অতুলের সঙ্গে তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়; গ্রামে ফিরে এসে তারা শুনতে পায় অতুল কলকাতা শিক্ষিত তার ছোট চাচার মেয়েকে বিয়ে করবে। বাড়িতে ফিরে এসে দুর্গামনি আর জ্ঞানদার অপমান, কষ্ট পাঠকের শ্বাসরোধ করে। জ্ঞানদার মা যে জ্ঞানদাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত অত্যাচারীদের হাত থেকে আগলে রাখত সেই এই মেয়ের কারণে এত বেশি অপমানের শিকার যে ভর্ৎসনা করে তার মেয়ের মৃত্যু কামনা করে-হ্যাঁ লা গেনি, শত ধিক্কারেও তোর প্রাণ বেরোয় না। যদু ঘোষের এক ছেলে সেদিন তিন দিনের জ্বরে মলো- আর একটা বছর ধরে তুই নিত্য জ্বরের সঙ্গে যুঝচিস, কিন্তু তোকে তো যম নিতে পারলে না। তুই বলে এখনও মুখ দেখাস।’ এ এক দারুণ বিষাদময় ক্ষণ; জ্ঞানদাও জানে এই মানবেতর জীবন থেকে মৃত্যু অনেক শ্রেয় কিস্তু তার মাকে যে সে খুব ভালবাসে তাকে রেখে তার মৃত্যু চিন্তা সফল হয় না। জ্ঞানদার অবস্থা তার মায়ের মৃত্যুও পর আরও নিষ্ঠুর পরিণতি লাভ করতে পারত কিন্তু শেষ অংশে এসে অতুলের পরিবর্তন ও সেই স্মৃতি যে জ্ঞানদা একদিন সেবা করে তাকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল- আর তার পুরনো ভালবাসার কাছে আবার ফিরে আসে; এবং জ্ঞানদাকে তার ভালবাসার কাছে টেনে নেয়। দেনা-পাওনা শরৎ চন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ষোড়শী এর প্রধানতম চরিত্র। ষোড়শীকে মৃত্যুকালে তার মা জমিদার জীবানন্দের হাতে; কিন্তু অমিতাচারী, মদ্যপ, লোভী, অসংযমী জীবানন্দ ধোঁকা দেয় এবং দশ বছরের ষোড়শী বা অলকাকে সে একলা রেখে যৌতুকের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। শান্তিকুঞ্জে তাদের আবার দেখা হয় অনেককাল পরে যেখানে ষোড়শী মন্দিরের ভৈরবী বা সন্ন্যাসিনীর দায়িত্বে নিযুক্ত। ষোড়শী দৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী, সংযমী, গরিবদের সহায়। জীবানন্দ তার জমিদারির খোঁজ নিতে এসে ষোড়শীর বাবার কাছে অন্যায় খাজনা ধার্য করে; তার বাবা তা দিতে ব্যর্থ হলে পালিয়ে যায়। ষোড়শী জীবানন্দর কাছে এই কথা নিজে বলতে এসে তার খপ্পরে পড়ে কিন্তু সে রাতে জীবানন্দ প্রচ- লিভারের ব্যথায় মুমূর্ষু হয়ে পড়লে ষোড়শী তার সেবা করে; জীবানন্দ প্রাণে বাঁচলেও গ্রামময় ষোড়শীর নামে কুৎসার ঢেউ উৎত্তাল হয়ে ওঠে; দুর্দান্ত শয়তান জমিদার রায় বাবু, এককড়ি নন্দী প্রমুখ লোভী সমাজপতি এমনকি ষোড়শীর বাবা ষোড়শীর বিরুদ্ধে গিয়ে আর জীবানন্দের প্ররোচনায় ষোড়শীর ভৈরবী পদ, মন্দিরের সন্ন্যাসী পদ কেড়ে নেয়; কিন্তু অবিচল ষোড়শী নীরবে সব ত্যাগ করে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। বসু বাবুর কাছে ষোড়শীর নির্লিপ্ত উক্তি ‘নিরুপায় দুর্বল নারীর ভাগ্যে চিরদিন যা হয়ে আসচে, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।’ জীবানন্দ দেখে এককড়ির কাছে ষোড়শীর নামে যে অসত্য শুনেছে তা কত মিথ্যা; সাগর আর ষোড়শীর একান্ত অনুগতরা ষোড়শীর পায়ের কাছে মৃত্যু জেনেও দিনরাত পাহারায় থাকে। এ উপন্যাসে ষোড়শীর তার মুসলমান পীরের প্রতি ভক্তি; তার চরণ ধুলা মাথায় তুলে আশীর্বাদ নেয়া উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে। ষোড়শীর কাছে পশু জীবানন্দের পরাজয় ঘটে; ষোড়শী গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে সে এক পরিবর্তিত জমিদার তার লোভ দয়ায় পরিণত হয় জীবানন্দ প্রচ- আত্ম-দংশনে ষোড়শীর মতো সামাজিক উন্নয়নে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করে- জীবানন্দের উপলদ্ধি ‘স্ত্রী বলিয়া স্বীকার করিতে যাহাকে লজ্জাবোধ করিয়াছি, গণিকা বলিয়া তাহাকেই কামনা করিবার শয়তানী সে যে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া পাই না।’ কিন্তু তার বিরুদ্ধে রায় বাবুর অনিঃশেষ ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে অবশেষে ষোড়শী এসে পরিবর্তিত জীবানন্দকে উদ্ধার করে। ‘বড়দিদি’ শরৎ চন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস বড়দিদি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, বড়লোকের বিধবা মেয়ে মাধবী; বিধবা হয়ে সে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে আর পরম মমতায় আর মাতৃ ¯েœহে বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে আগলে রাখে। এই কম বয়সী মাতৃহীন শুভাকাক্সক্ষী মাধবী ছোট্ট বয়সে স্বামী হারানোর এত বড় ধাক্কা সে সয়ে যায় পরিবারের অন্য আর সবাইকে প্রীতিতে, যতেœ, আদরে বেঁধে রেখে। অন্যদিকে মাতাহীন এমএ পাস সুরেন্দ্র এক খেয়ালি, নির্বিকার চরিত্র, সে এক দিকহীন যুবক। সৎমায়ের বাড়াবাড়িতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে- কলকাতায় এসে দয়াদু ব্রজবাবুর বাসায় সে আশ্রয় পায়। ধীরে ধীরে সে ব্রজবাবুর বিধবা মেয়ে মাধবীর মধুর শাসনের বেড়াজালে আটকা পড়ে কিন্তু সে জে উদাসীন আর পৃথিবীর সব কিছুকে উপেক্ষা করে চলে তার সেই ঘোর পরের বাড়িতে এসেও কাটে না। মাধবী যে বাড়িতে বড়দিদি নামে পরিচিত রূপ, গুণ আর সদ্ব্যবহারে সে অতুলনীয়া; লেখকের ভাষায়- ‘তাহার নিজের হৃদয়ে অনেক ফুল ফোটে, আগে সে ফুলে মালা গাঁথিয়া সে স্বামীর গলায় পরাইয়া দিত। এখন স্বামী নাই, তাই বলিয়া ফুলগাছটি সে কাটিয়া ফেলে নাই। এখনও তাহাতে তেমনি ফুল ফোটে, ভূমে লুটাইয়া পড়ে এখন সে আর মালা গাঁথিতে যায় না সত্য, গুচ্ছ করিয়া অঞ্জলি ভরিয়া দীন-দুঃখীকে তাহা বিলাইয়া দেয়। যাহার নাই, তাহাকেই দেয়, এতটুকু কার্পণ্য নাই।’ বড়দিদির উদারতার সীমা যে কতদূরব্যাপী তা লেখক আবার বলেন’Ñ বাড়ির পোষা কুকুরটা পর্যন্ত দিনান্তে একবার ‘বড়দিদিকে’ দেখিতে চাহে।’ সুন্দরী বিধবা বড়দিদি বুঝতে পারে সুরেন্দ্র বড় ঘরেরই সন্তান তাই তার এত বেশি উদাসীনতা- মাধবী সুরেন্দ্রর প্রতি অকারণ ভালবাসায় সিক্ত হয়; তাকেও আগলিয়ে রাখে কিন্তু একদিন বড়দিদির সঙ্গে অভিমান করে অর্বাচীন সুরেন্দ্র ব্রজবাবুর গৃহ ত্যাগ করে। বড় দুর্ঘটনায় আহত হয় তারপরে বড়দিদির সঙ্গে হয় বিচ্ছেদ। মাধবী জানে এই গৃহত্যাগী অন্যমনস্ক বালক-প্রায় সুরেন্দ্র অভুক্ত অবস্থায় দিনানিপাত করছে তাই মাধবীও স্বার্থহীন ভালবাসায় অন্নত্যাগ করে। মাধবীর বান্ধবী মাধবীর এই ভগ্নদশা দেখে ঠাট্টার ছলেই বলে মাধবীর অমন রাঙা পায়ের সৌন্দর্যও কি সুরেন্দ্রকে বাঁধতে পারল না? মাধবী জানে বিধবার হৃদয়ের ভালবাসার মূল্য কঠোর হিন্দু সমাজে নিষিদ্ধ তাই তার সকরুণ অশ্রুসজল উক্তি- ‘আমি যে বিধবা দিদি!’ মাধবীর বাড়িতে ভাই বউ আসে মাধবী হারিয়ে ফেলে তার কর্তৃত্ব; ভালবাসবারও অধিকার হারায় তাই সে ফিরে যায় তার মৃত স্বামীর পল্লীতে। আর অন্যদিকে সুরেন্দ্র বিয়ে করে কিন্তু কিছু একটা অপূর্ণতা তাকে তাড়া করে ফেরে তার স্ত্রী শান্তি পতিব্রতা, সর্বংসহা কিন্তু সুরেন্দ্রর মনে পূর্ণ শান্তি সে দিতে পারে না। শেষ অবধি মাধবী সুরেন্দ্রর মিলন হয় কিন্তু শেষ মুহূর্তে যখন সুরন্দ্র মৃত শয্যায়। অন্যদিকে শরৎ চন্দ্র তার ছোটগল্পেও তার নারী চরিত্রগুলোকে মহিমান্বিত করেছেন ধৈর্য, সহিঞ্চুতা, স্বার্থহীন আর আত্মত্যাগে মহীয়ান করে। মেজদিদি গল্পের হেমাঙ্গিনী এমনি এক নারী; যার মন গরিব, দুঃখী, সহায়-সম্বলহীনের দুর্দশায় গলে পড়ে অন্যের কল্যাণ, শুভ আর মঙ্গল কামনায়। এই দয়াদ্র নারীটি তার জা কাদম্বিনীর বৈমাত্রেয় ভাই কেষ্টার প্রতি অবিচার, অত্যাচারে পিতামাতাহীন নিঃস্ব, রিক্ত কেষ্টার পাশে না দাঁড়ালে কেষ্টা হয়ত মরেও যেতে পারত। কাদম্বিনী এক জাত সৎবোন। কেষ্টাকে না খাইয়ে রাখা, ছেলে স্বামীকে দিয়ে মারধর করানো, অন্যায় অপবাদ দেয়া, চাকরের মতো খাটানো কিছুই বাকি রাখে না- কেষ্টা যখন পৃথিবীতে ভাল বলে কিছু আছে তা ভুলতে বসেছিল তখন হেমাঙ্গিনীর কোমল, মিষ্টি, প্রশয়ের কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে- লেখকের উপলব্ধিÑ ‘এ দেশে এমন করিয়া যে কেহ কথা বলিতে পারে, ইহা যেন তাহার মাথায় ঢুকিল না।’ যখন কেষ্টার প্রতি নির্মমতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে তখন হেমাঙ্গিনী কাতর হয়ে পড়ে; হয়ে পড়ে অসুস্থ কিন্তু সমাজের বয়স্ক ব্যক্তিগুলো যে পাষ- বধির তা কাদম্বিনী, তার স্বামী আর হেমাঙ্গিনীর নাম্নীর আচরণেই প্রকাশ পায়। ধার্মিক হেমাঙ্গিনী তার স্বামী যে তার বিরুদ্ধে কিন্তু হেমাঙ্গিনীকে অত্যন্ত ভালবাসে; যখন তার স্বামী তার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তার শ্রান্ত কণ্ঠে আকুতি ঝরে- ‘কেষ্টাকে আশ্রয় দাও, নইলে আমার এ জ্বর সারবে না। মা দুর্গা আমাকে কিছুতে মাপ করবেন না।’ কিন্তু তার স্বামী যখন প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভঙ্গ করে তখন হেমাঙ্গিনী কেষ্টাকে নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে কেষ্টার বিহিতের জন্য অজানায় পাড়ি দেয়; তখন তার স্বামী বুঝতে পারে গ্রামের এক গরিবের জমি বাঁচানোর জন্য আরেকবার যেমন হেমাঙ্গিনী রুদ্র হয়েছিল এবারও তাই হয়েছে। সে অনুনয় করে ‘মাপ কর মেজ বউ, বাড়ি চল!’ হেমাঙ্গিনীর উত্তর-‘কাজ না সেরে আমি কোন মতেই বাড়ি ফিরতে পারব না।’ তাই তার স্বামী বাধ্য হয় আর হেমাঙ্গিনীর মাতৃপ্রেম জয়লাভ। শরৎ চন্দ্রের বেশিরভাগ নির্যাতিতা নারী দরিদ্র কিন্তু ধনাঢ্য, সম্পদশালী বাবার মেয়েরাও যে সমাজের কুপ্রথার নির্মমতায় বিদীর্ণ হয় ‘অনুপমার প্রেম’-এর অনুপমার এক মর্মস্পর্শী উদাহরণ। ধনীর রাজকন্যা কিন্তু বিয়ের ক্ষণে হবু স্বামীর পলায়ন, পিতৃবিয়োগের পর সৎ ভাই দ্বারা নির্যাতিত, পঞ্চাশর্ধো বুড়োকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া, তারপর বিধবা হয়ে সৎ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে সবকিছু হারিয়ে বাড়ির কাজের মেয়ের উপহাসের পাত্রী হয়ে যাওয়া এতসব অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে অনুপমা সমাজে নারীদের অস্তিত্বের অশনি সঙ্কেত ঘোষণা করে যদি না শেষ মুহূর্তে ললিতমোহনকে সমাজে অবাঞ্ছিত তাকে রক্ষা করত তবে সব ধরনের নির্মমতাকে হার মানাত অনুপমার নিদারুণ বেদনার জীবন। অন্যদিকে বিলাসী যার সেবায় মৃত্যুঞ্জয় মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসে সমাজের ভদ্রলোকেরা তাকে মেরে চুলের মুঠি ধরে গ্রামছাড়া করে কারণ শুদ্ধস্থানে অশুচি মেয়েলোকের স্থান নেই। শরৎ চন্দ্র তার লেখায় যে নারীর চিত্র শতবর্ষ আগে এঁকে গিয়েছেলেন আজ তার থেকে নারীরা কতটা নিরাপদ আর সুখকর অবস্থানে আছে তা অজানাই থেকে গেছে; আমরা এখন আধুনিক নারীদের অনেক বেশি অধিকারভোগী, স্বাধীন, মুক্ত, স্বনির্ভর হতে দেখি কিন্তু ভেতরের অবস্থা; পল্লী গ্রামে অশিক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত, পরিত্যক্ত, দরিদ্র নারীরা কেমন অবস্থায় আছে তা খুব কম জানি। আলোকের প্রকাশে সুন্দর, সুখী নারীর সংখ্যার চেয়ে অন্ধকারে অসুখী, বেদনাক্লিষ্ট নারীর সংখ্যা যে এখন আরও বেড়েছে তাতে সন্দেহ প্রকাশ করা কতটা সত্যতার উর্ধে তা নিয়ে তর্ক চলে না।
×