ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর ও জয়’

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর ও জয়’

১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কাব্যগ্রন্থ সাম্যবাদীতে সংকলিত নারী কবিতার শেষ পঙ্ক্তিদ্বয় আজ বর্তমান হয়েছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নজরুল নারী জাতিকে অধিকার সচেতন হবার আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। এ ক্ষেত্রে পুরুষ জাতিকে বদ্ধমূল ধারণা আর নারী শাসনের মনোভাব পরিত্যাগেরও উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। নারীকে দাসীরূপে ব্যবহার হয়ত পুরনো যুগের কাহিনী। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত পুরুষদের নারী শোষণ ও দাসত্ব শৃঙ্খলযুক্ত পুরনো মনোভাব পোষণ ঠিক নয়। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন- ‘সে যুগ হয়েছে বাসি যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা ছিল দাসী। বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডন্কা বাজি। বাংলার সামাজিক জীবনে নারীরা যেমন উপেক্ষিত ছিল, সাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিশেষত, মুসলমান নারীর অবস্থান ছিল আরও শোচনীয়। কাজী নজরুল যখন থেকে সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত হন তখন থেকেই সমাজে নারীর প্রতিষ্ঠা ও যথোচিত মর্যাদা প্রদানের জন্য যেমন তিনি প্রবন্ধ রচনা করেন, তেমনই গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটকে চিত্রিত করেন অসংখ্য নারীমূর্তি। মূলত তার লেখাতে নারী জীবনের বহুমাত্রিকতা এবং মুসলিম নারীর জাগরণী মন্ত্রণা ব্যাপকভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। বাঙালী সমাজে নারীর পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। নজরুল যেমন নিজ জীবনে র্ধম বর্ণের উর্ধে উঠে নারীত্বের মহিমাকে শ্রদ্ধা করেছেন তেমনিই সাহিত্যে ও তাঁর নারীরা হয়ে উঠেছে মুক্ত জীবন সন্ধানী। তেমনই এই যুক্তির সঙ্গে নারীর জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের অগ্রগামী হওয়ার আহ্বানে ও তাঁর কণ্ঠ ভীষণ জোরালো- ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা।’ নজরুল তাঁর জীবন ও র্কম সাধনার মাধ্যমে অবহেলিত নারীর সামাজিক মর্যাদা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষায় তাদের অধিকার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নারীর অবরোধ ও অধিকার হরণের হোতা পুরুষ সমাজ হলেও- নারী নিজে ও এর জন্য দায়ী। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যারা শৃঙ্খলিত হয় তাদের মধ্যে যদি শৃঙ্খল দূর করার অভিলাষ না থাকে তাহলে মুক্তি আসা অসম্ভব। তাই সামগ্রিকভাবে শোষণ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি অর্জন করতে চাইলে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে বলে নজরুল মনে করেছেন। অবশ্যই এ সংগ্রাম নারীর একার নয়, পুরুষেরও দায়িত্ব রয়েছে। আবার নারীকে ও মনে রাখতে হবে কেউ কাউকে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে ছাড় বা অধিকার দেয় না। অধিকার পেতে হলে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে- যা শ্রমে, কর্মে, শিক্ষায়, নেতৃত্বে সকল ক্ষেত্রে সকল পর্যায়ে পুরুষের পাশে, হাতে হাতে- একসঙ্গে হতে হবে। নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন পুরুষের অবরোধ আরোপের পথকে সুগম করেছে নারীর অশিক্ষা। সমকালীন মুসলিম নারী সমাজের বেদনা ও বিড়ম্বনা নজরুল মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন। নারীকে অবরুদ্ধ করে তাদের যেভাবে হীনম্মন্যতার গহ্বরে নিক্ষেপ করা হচ্ছে সেখানে অন্ধকার সহজেই বিস্তার লাভ করে থাকে। নজরুল নারী শিক্ষার গুরুত্ব যর্থাথভাবে বুঝতে পেরে লিখেছেন- ‘মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু“ ওড়াও সে আবরণ দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন যেথা যত আভরণ।’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের চিন্তা-চেতনায় নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা ছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যুগ যুগ ধরে নানাভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়ে আসছে, এসকল ঘটনা-নিগ্রহ নজরুলকে পীড়া দিত। সমাজে যাতে নারী তার পূর্ণ অধিকারে অধিষ্টিত হয় এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক । শিল্প-শিক্ষা সংস্কৃতি-সহ সমাজের সব ধরনের কাজে নারীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি সংস্কার, অবরোধ ও বদ্ধমূলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন অন্যদিকে নারীদেরও সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। ১৯৩২ সালের নবেম্বরে সিরাজগঞ্জের বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছিলেনÑ ‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনে ও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগীদের চির বাদিনী করিয়া রাখিতেছি। আমাদের শত শত বছরের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহমন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাইরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কি দুঃখ কিসের অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে। আমরা মুসলমান বলিয়া ফখর করি, অথচ জানি না- সর্ব প্রথম মুসলমান নর নহে, নারী।’ নজরুল সবসময়ই সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে নারীর অবরোধ প্রথার বিলোপ এবং তাদের শিক্ষার আলোকে আলোকিত করাকে তার লেখনিতে তুলে ধরেছেন। নজরুল সমকালে নারী সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে যারা একনিষ্ঠভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে কাজ করেছিলেন মিসেস এম রহমান, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কখনও কখনও মৌখিকভাবে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ব্যাপারটি স্বীকার করা হলে ও বাস্তবক্ষেত্রে অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। তাই নজরুল ’নারী’ কবিতায় ঘোষণা করলেন- ‘সাম্যের গান গাই, আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা কিছু এল পাপ- তাপ বেদনা অশ্রুবারি অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’ ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিটি সফলতার নেপথ্যে কাজ করেছে নারীর প্রেরণা, রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি। তাই তো কবি বলেছেন- ‘কোনকালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’ কিন্তু নারীর সে অবদান যথাযথভাবে উঠে আসেনি, এ ব্যর্থতার দায় সমাজের এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। ‘জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে। কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি- স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? ’ আশার কথা যে, সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। একবিংশ শতাব্দীর এই দিনে নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে উঠছে, আর এখানেই কবির সার্থকতা প্রতীয়মান।
×