ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন সহিংসতা বাড়ছে

গত আট মাসে সাড়ে ৩ হাজার নারী শিশু নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গত আট মাসে সাড়ে ৩ হাজার নারী শিশু নির্যাতনের শিকার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সম্প্রতি ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজের ছাত্রী এবং একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রমোশনাল ডিভিশনের কর্মী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে সুপারভাইজারসহ পাঁচ জন পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণের পর ঘাড় মটকে ও মাথা থেঁতলে হত্যা করে এবং রাস্তার পাশে লাশ ফেলে দেয়। ২০১৫ সালের মে মাসে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে রাজধানীতে গণধর্ষণের শিকার হন এক গারো তরুণী (২২)। কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত। যমুনা ফিউচার পার্কে একটি পোশাকের দোকানে কাজ করতেন ওই গারো তরুণী। তাহলে নারীরা কী যানবাহনেও নিরাপদ নন। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস এমনকি নৌযানেও নারীরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সারাদেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী বিগত আট মাসে ৩ হাজার ৪৭৪ নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জনুয়ারিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৬৫, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৬, মার্চে ৪০৬, এপ্রিলে ৪১৯, মে মাসে ৪৫৩, জুনে ৩৮১, জুলাইয়ে ৫৪৪ ও আগস্টে ৫৩০ নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ নারী, অগ্নিদগ্ধের কারণে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের, যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১০৯ জনকে, গৃহপরিচারিকা হত্যা ১১, বিভিন্ন সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ৪৪০ নারীর। এছাড়া আত্মহত্যা করেছে ২২৫ নারী, উত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ২০ নারী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম দেশে ক্রমাগত বেড়ে-চলা শিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনাগুলোর উল্লেখ করে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সচেতন নাগরিক সমাজের কঠোর নজরদারি বাড়ানো দরকার। ক্রমবর্ধমান এই নারী নির্যাতনকে জাতীয় একটি দুর্যোগের মতো বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সকলে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করে। এই অপশক্তির কাছে ক্রমে যেন পুরো সমাজ ও দেশবাসী জিম্মি হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এসব নৃশংস নারী নির্যাতন ও হত্যা চলতে থাকলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- কোন সুফলই বয়ে আনবে না, বরং দেশ ও সমাজে নিরাপত্তাহীনতার ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’ অন্যদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্যমতে গত আট মাসে ৯৪৮ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১, স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৭৭, আত্মহত্যা করেছেন ২৫৫ নারী। যেখানে ২০১৬ সালে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৯ এবং তার আগের বছর ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৬০। বিগত বছরগুলোর তুলনায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে উদ্বিগ্নতা। আশঙ্কাজনক হারে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে ‘সাম্প্রতিক নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই তা বেড়ে চলেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০০১ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি জেলায় এ ধরনের মামলার রায় দেয়ার জন্য একজন করে বিচারক থাকার কথা। কিন্তু অনেক জেলা আছে, যেখানে এই ট্রাইব্যুনালের কোন বিচারক নেই। সে কারণে মামলাগুলোর রায় বা বিচার হতে দেরি হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে কোন মামলার রায় হতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে কোন মেয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হয়ে মামলা করে, বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে সে সমাজ, পরিবারের কাছে নানাভাবে অবহেলা-হয়রানির শিকার হয়। এতে করে অনেকের পক্ষেই শেষ পর্যন্ত মামলাটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে সমাজে ধর্ষণের বিচার দৃশ্যমান হয় না বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে বর্তমানে নারী নির্যাতনের মামলার অনেক অপরাধীরাই শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সংখ্যা নিতান্তই কম। যে কারণে অন্যন্য অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে।’ বিগত দু’দশকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে। সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
×